সকল বিদায়াত'ই গোমরাহী?
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন "كل بدعة ضلالة" সকল বিদায়াত গোমরাহি।
অধিকাংশ মুহাদ্দিসদের মতে হাদীসটি আম তবে উদ্দেশ্য খাছ। তথা হাদীসটি সকল বিদআতকে শামিল করলেও এখানে নির্দিষ্ট কিছু বেদায়াতকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। সকলের বোধগম্যের উদ্দেশ্যে আমি কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি একটি বিষয় আম বা ব্যাপক হওয়ার পরেও কিভাবে খাছ বা নির্দিষ্ট হতে পারে।
১। আল্লাহ তায়া’লা এরশাদ করেছেন -
وَإِنِّي كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُوا أَصَابِعَهُمْ فِي آذَانِهِمْ وَاسْتَغْشَوْا ثِيَابَهُمْ وَأَصَرُّوا وَاسْتَكْبَرُوا اسْتِكْبَارًا
অর্থাৎ আমি যখনই তাদেরকে দাওয়াত দিয়েছি, যাতে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তখনই তারা তাদের কানে আঙ্গুল রেখেছে, নিজেদের কাপড় দ্বারা নিজেদেরকে ঢেকে ফেলেছে, (নিজেদের কথার উপর) জিদ বজায় রেখেছে এবং শুধু অহমিকাই প্রকাশ করেছে।
-সূরা নূহ আয়াত ০৭
উপরের আয়াতটিতে হযরত নূহ আলাইহি সাল্লাম তাঁর সমসাময়িক লোকদের ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে অভিযোগ করেছিলেন; তা বর্ণিত হয়েছে। এখানে একটি বিষয় খেয়াল করুন, নূহ আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম এর কথা,'আমি যখনই তাদেরকে দাওয়াত দিয়েছি' বাক্য দ্বারা দলবল নির্বিশেষে তার সমসাময়িক সকল লোক'ই উদ্দেশ্য বুঝা যায় অথচ ব্যাপারটা তা নয়। বরং নির্দিষ্ট কিছু মানুষ উদ্দেশ্য যারা তাঁর দাওয়াত কবুল করে নি। কেননা তাঁর দাওয়াতে যারা ঈমান আনয়ন করেছেন তারা তো কানে আঙ্গুল দিতো না এবং কাপড়ে মুখ ঢেকে নিতো না। এখানে আয়াতটি বাহ্যিক ভাবে সকল লোককে বুঝালেও উদ্দেশ্য শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু স্বেচ্ছাচারী নারী-পুরুষ।
২। আল্লাহ তায়া’লা অন্যত্রে বলেন,
تُدَمِّرُ كُلَّ شَيْءٍ بِأَمْرِ رَبِّهَا فَأَصْبَحُوا لَا يُرَىٰ إِلَّا مَسَاكِنُهُمْ ۚ كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْقَوْمَ الْمُجْرِمِينَ
অর্থাৎ ওটা (মেঘমালাবহ ধমকা বাতাস) তার প্রতিপালকের নির্দেশে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। অবস্থা এই দাঁড়াল যে, তাদের (ধ্বংসপ্রাপ্ত) বসতিগুলো ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। অপরাধী জাতিকে আমি এভাবেই প্রতিফল দিয়ে থাকি।
-সূরা আহক্বাফ, আয়াত নং-২৫
এই আায়াতে আ'দ জাতির আজাবের কথা বিবৃত হয়েছে। এই আয়াতের প্রথমদিকে আল্লাহ তায়া’লা বাণী, 'ওটা (মেঘমালাবহ ধমকা বাতাস) তার প্রতিপালকের নির্দেশে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে', বাক্য দ্বারা বুঝা যায় আসমান জমিন, পাহাড় পর্বত, চাঁদ সুরুজ সকল কিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল অথচ ব্যাপার টা তা নয়। বরং নির্দিষ্ট জনপদের ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে। কারণ আয়াতটি আম বা ব্যাপক তথা আসমান জমিন, পাহাড় পর্বত, চাঁদ সুরুজ সকল কিছু কে শামিল করলেও বস্তুত এই আয়াতটির উদ্দেশ্য খাছ বা সুনির্দিষ্ট জনপদ তথা আদ জাতি।
এখন প্রশ্ন হতে পারে-
তাহলে "সকল বিদায়াত গোমরাহি" বাক্য দ্বারা খাছ উদ্দেশ্য টি কি?
সকল বিদায়াত দ্বারা ছালাছে কুরুনের পরে আবিস্কৃত সকল নতুন বিষয় উদ্দেশ্য নয় বরং এমন সব বিদায়াত তথা নতুন আবিস্কৃত বিষয় উদ্দেশ্য হবে যেগুলো উসূলূশ শরীয়াহর পরিপন্থী। সকল বিদায়াত বলে উসূলুশ শরীয়াহ দ্বারা সাবিত বিদায়াত উদ্দেশ্য হবে না। এই কারণে'ই অসংখ্য আলিমরা বিদায়াতে হাসানাহ এবং সাইয়িয়্যাহ বলে বিদায়াতের বিভাজন ইজতিহাদ করেছেন।
আর এই বিষয় টি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এই হাদীস দ্বারা সহজে বুঝাযায়- এই হাদিসে প্রিয়নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নেক প্রথার প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন-
مَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَ أَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا إِلىَ يَوْمِ القِيَامَةِ»
যে ব্যাক্তি ইসলামে কোন নেক প্রথা চালু করবে, সে তার নেককর্মের সাওয়াব পাবে এবং ঐ ব্যাক্তির সম পরিমাণ সাওয়াবও লাভ করবে যে ব্যাক্তি তার পরে ঐ নেক আমল করবে, এতে তাদের নেকী বিন্দুমাত্র ও কমবে না। পক্ষান্তরে যদি কোন ব্যাক্তি ইসলামে কোন কুপ্রথা চালু করে তবে এ অসৎকর্মের গুনাহ তার উপর বর্তাবে এবং ঐ ব্যাক্তির গুনাহও, যারা তার পরবর্তীতে সে অসৎকর্ম করবে, এতে তাদের গুনাহ বিন্দু পরিমাণও কমবে না।
-মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ২২২৩। ইফা।
উপরের হাদিসটি মুজার গোত্রের কিছু অসহায় মানুষদের সহায়তা কল্পে, জনৈক সাহাবীর অভিনব পদ্ধতিতে দান-খয়রাতে উৎসাহী হয়ে অন্যান্য সাহাবীদের রাঃ দানের প্রশংসা করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।
আরও পড়ুন: বিদায়াতে হাসানাহ কাকে বলে?
বিষয়টি একটু খোলাসা করে বলি-
সামর্থবান সাহাবায়ে কেরামরা দান খয়রাতে প্রায় সবাই অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু জনৈক সাহাবী মুজার গোত্রের অভাবীদের দান খয়রাতে একটু বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন যা ইতিপূর্বে পরিলক্ষিত হয়নি তখন তার দেখাদেখি অন্যান্য সাহাবীরা-ও সে পদ্ধতি অবলম্বন করে দান করা শুরু করলেন। আর এতে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরের হাদিসটি এরশাদ করলেন।
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম বৃত্তান্ত (মিলাদ-মাহফিল) আলোচনা করুনে ছালাছায়ে ছিলো। কিন্তু নতুন আবিস্কৃত এই পদ্ধতি ছিলো না। পদ্ধতি চেঞ্জ হওয়ার দরুন মিলাদ-মাহফিল ( জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা) বিদায়াত হয়ে যায় না। বরং আবিস্কৃত পদ্ধতিটি মুনকারাত মুক্ত তথা উসূলুশ শরীয়াহর পরিপন্থী না-হলে সেটি কখনোই পরিত্যজ্য বিদায়াত বলে অভিহিত হবে না।
ফরজ নামাজের পরে হাত তুলে মুনাজাত, হাজির-নাজির না মনে করে স্রেফ তা'জিমান দাড়িয়ে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সালাম দেওয়া'সহ যাবতীয় বিদায়াতে হাসানাহ গুলো কখনোই পরিত্যাজ্য বা গোমরাহি বিদায়াত হবে না। বরং উসূলুশ শরীয়াহ সমর্থিত অভিনব পদ্ধতিতে হওয়ায় রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসার অধিকারী হবেন।
আল্লাহু আ'লাম।