একটি শিক্ষা সফরের অভিজ্ঞতা - একটি স্বরণীয় দিন
আমাদের সফরটি ছিল শীত শেষে বসন্তের প্রাক্কালে। সিডিউল অনুযায়ী আমাদের বাসটি ৪ঠা ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যারাতে মাদ্রাসার ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। ছাত্র জীবনে অসংখ্য শিক্ষা সফরে অংশগ্রহণ করলেও শিক্ষক হিসেবে এটিই আমার প্রথম সফর। ছাত্র জীবনে শিক্ষা সফরে এক ধরনের ভালোলাগা অনুভব হলেও এবারের ভাললাগাটি ধরা দিয়েছে অন্যভাবে। ছাত্রদের আনন্দ উল্লাস স্বচক্ষে অবলোকন করার মাঝে যে শিক্ষক হৃদয়ে তৃপ্তি অনুভব হয় তা ইতিপূর্বে আমার কল্পনাতেই ছিল না।
{getToc} $title={Table of Contents}
মাদ্রাসার এবারের শিক্ষা সফরটি ছিল কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। মধ্যরাতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতার কবর জিয়ারতের মধ্য দিয়ে আমাদের সফরের যাত্রা শুরু করেছিলাম। এবারের সফরটি ছিল কুমিল্লার বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান ঘিরে। যথাক্রমে -
★হাজীগন্জ বড় মসজিদ।
★ লালমাই পাহাড়।
★লালমাই লেকল্যান্ড
★ শালবনবিহার।
★ময়নামতি যাদুঘর।
★ব্লু ওয়াটার পার্ক।
★বৃক্ষ জাদুঘর।
হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ
এই মসজিদটিকে চাঁদপুর জেলার সবচেয়ে পুরোনো মসজিদ হিসেবে ধরা হয়। এই মসজিদটির প্রথম উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা হাজী আহম্মদ আলী পাটওয়ারী। প্রায় ১৯৩১ খ্রিঃ কাজ শুরু হয়ে ১৯৩৭ সালে নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়। ২টি গম্বুজ এবং ২টি মিনার নিয়ে গঠিত মসজিদটি ২৮,৪০৫ বর্গফুট এরিয়া নিয়ে বিস্তৃত। ১টি মিনারের উচ্চতা প্রায় ১২১ ফুট।
মসজিদটি তৈরি করার সময় হাজীগঞ্জ বা এর আশাপাশের কোনো এলাকাতে কোনো ইট ভাটা ছিলোনা। তখন মসজিদটির উদ্যোক্তা সেখানে একটি ইট ভাটা তৈরি করেন। তারপর সেখানে ইট তৈরি করে সেই ইট দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করেন। এছাড়াও তিনি মসজিদ নির্মাণের জন্য জাহাজ ভাড়া করে ভারতের কলকাতায় গিয়ে লোহার বীম ও মর্মর পাথর কিনে আনেন। পরবর্তীতে মসজিদটির কাজ ১৯৩৭ খ্রিঃ দিকে শেষ হয় এবং শুক্রবার দিন মসজিদে আজান দেওয়ার মাধ্যমে মসজিদটির উদ্বোধন করা হয়।
মসজিদে এসেই মাদ্রাসার নায়েবে মুদীর মসজিদ সংক্রান্ত যাবতীয় ইতিহাস ঐতিহ্য এবং পাশে থাকা সাইনবোর্ডে মসজিদে আগত বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামের তালিকা এবং তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী হৃদয়গ্রাহী ভাষায় উপস্থাপন করেছিলেন। ইত্যবসরে ডাইবার মামার ডাকাডাকিতে দায়িত্বরত শিক্ষকমণ্ডলী ছাত্রদের গাড়িতে উঠিয়ে লালমাই পাহাড়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন।
গাড়িতে ছাত্রদের নিত্যনতুন উপস্থাপনে আলাদা আনন্দ যুক্ত করেছিলো হাফেজ সাহেবের তাহেরী জিকিরের আয়োজন। ছাত্রদের পাখির মতো কিচিরমিচির শব্দ আর মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ার প্রবণতা পুরো সফরটির আনন্দ দ্বিগুণ করে তুলেছিলো।
ইতিমধ্যেই আমাদের গাড়ি লালমাই'র পাদদেশে থামল। ততক্ষণে মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ভেসে আসছিলো "আস-সালাতু খাইরুম মিনান-নাউম"। নামাজান্তে শুরু হলো পায়ে হেটে লালমাই পাহাড় এবং পাহাড়ি মানুষের জীবনাচার স্বচক্ষে অবলোকন পর্ব। প্রায় পৌনে দুই ঘন্টা পাহাড় এবং পাহাড়িদের জীবনযাত্রা এবং সামাজিক অবকাঠামো থেকে অর্জিত শিক্ষা নিয়ে গাড়ি ছুটে চলল শালবন বিহারের উদ্দেশ্যে।
ওহ, পাহাড়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা নতুন একটি দর্শনীয় স্থানে এসে উপনীত হলাম যেটি আমাদের প্লানিংয়ে ছিলো না। লালমাই লেকল্যান্ড গেইটে লেখা দেখে বুঝতে পারছিলাম এটি একটি দর্শনীয় স্থান। অনেক সকাল থাকায় গেইটম্যান তখনো না-আসায় গেইটে দাঁড়িয়ে কয়েকটি পিকচার তুলে খাবার পর্ব এখানেই সেরে আমরা রওয়ানা হলাম শালবন বিহারে।
পথিমধ্যে বাসে আবার শুরু হলো কৌতুকের উপস্থাপন। যে যেভাবে পারছে আনন্দ উল্লাসে
মেতে উঠছে। আমাদের শিক্ষকদের পিতৃতুল্য মৃদু শাসন আর বিভিন্ন শিক্ষনীয়
চিন্তা-জাগানিয়া, বিশ্লেষনী দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনায় উঠে আসছিলো শিক্ষা সফরের
গুরুত্ব আর বই'র পাতার বাহিরের জ্ঞান। কয়েকজন শিক্ষক আবার চিরাচরিত গুরুগম্ভীর
ভাব ছেড়ে ফ্রেন্ডলি আচারনে মুগ্ধ করে রাখছিলো ছাত্রদের একাংশকে।
শালবন বৌদ্ধ বিহার
অবশেষে আমরা এসে পৌঁছলাম শালবন বিহারের গেটে। ছাত্রদের উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে অবশেষে আমরা বিহারে প্রবেশ করলাম। আমি এবং নায়েবে মুদীর চেষ্টা করছিলাম দলবদ্ধ ভাবে ছাত্রদের বিহার সংক্রান্ত ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরতে। কিন্তু মধুমক্ষিকারা নিজেরাই প্রত্যেকটি স্থাপনার সাইনবোর্ড থেকে খুটিনাটি জেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এসব পাখপাখালিদের জ্ঞান ক্ষুধার তাড়না আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করেছে।
শালবন বৌদ্ধ বিহার (Shalbon Buddha Bihar) কুমিল্লা জেলার কোটবাড়িতে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন। তৎকালীন সময় এই অঞ্চলে শাল ও গজারির বন ছিল বলে এটি শালবন বিহার নামে পরিচিতি লাভ করে। কোটবাড়ি এলাকায় ১৮৭৫ সালে রাস্তা তৈরির সময় একটি ইমারতের ধ্বংশাবশেষ সকলে প্রত্যক্ষ করেন। । ১৯১৭ সালে ঢাকা জাদুঘরের অধ্যক্ষ নলিনী কান্ত ভট্টাশালী শালবন বৌদ্ধ বিহারটিকে পর্যবেক্ষন করে পট্টিকেরা নগর বলে মতামত পেশ করেন।
শালবন বিহারটি দেখতে চতুর্ভুজের মতো। এর প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬৭.৭ মিটার। চতুর্দিকে বিহারের দেয়াল প্রায় ০৫ মিটার পুরু এবং বিহারের কক্ষগুলো চারপাশের বেষ্টনী দেয়ালের সাথে পিঠ করে নির্মিত। বিহারে প্রবেশের জন্য উত্তর ব্লকের মাঝামাঝি একটি দরজা রয়েছে। বিহারে সর্বমোট ১৫৫ টি কক্ষ এবং ঠিক মাঝখানে কেন্দ্রীয় মন্দিরকে চিহ্নিত করা রয়েছে। এসব কক্ষে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করতেন এবং ধর্মচর্চা করতেন বলে জানাযায়।
কক্ষের সামনের দিকে টানা বারান্দা ও শেষ প্রান্তে দেয়াল দেখা যায়। প্রত্যেক কক্ষের দেয়ালে প্রতিমা বা তেলের প্রদীপ রাখার তিনটি করে কুলুঙ্গি রয়েছে। অন্য পাশে চারটি বিশাল স্তম্ভের ওপর নির্মিত একটি হলঘর দেখা যায়। বলা হয়ে থাকে এই হলঘরটি ভিক্ষুদের খাবারের জন্য ব্যবহার করা হত। বিভিন্ন সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যক্রমের মাধ্যমে শালবন বৌদ্ধ বিহার থেকে প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ব্রৌঞ্জ ও মাটির মূর্তি, ০৮টি তাম্রলিপি, সিলমোহর, অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে এসব নিদর্শনের সিংহভাগই ময়নামতি জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে।
ময়নামতি জাদুঘর
শ্রীভবদের মহাবিহার, কোটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়া, রূপবানমুড়া, ইটাখোলা মুড়া, আনন্দ বিহার, রানীর বাংলা, ও ভোজ রাজার বাড়ি বিহার খননকালে অনেক মুল্যবান পুরাসামগ্রী খুঁজে পাওয়া যায়। এসব পুরাবস্তু সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য ১৯৬৫ সালে কুমিল্লা কোটবাড়ির শালবন বিহারের দক্ষিণ পাশে শালবনকে সামনে রেখে পশ্চিমমুখী একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়।
জাদুঘরের মূলভবনে গুরুত্বপূর্ণ পুরাবস্তু প্রদর্শনের জন্য স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১৯৭০-৭১ সালে এর দক্ষিণ পাশ বর্ধিত করায় বর্তমানে ভবনটি ইংরেজী ‘টি’র আকার ধারণ করে।
পুরো জাদুঘর ভবনে মোট ৪২টি এরিয়া রয়েছে। জাদুঘরের প্রবেশ পথের বাম দিকে থেকে ১নং প্রদর্শনী এরিয়া দিয়ে প্রদর্শনী আরম্ভ করে ক্রমানুসারে চারদিক ঘুরে ঘুরে প্রবেশ দ্বারের ডান দিকে ৪২নং এরিয়ায় প্রদর্শনী শেষ হয়েছে।
প্রদর্শনী এরিয়াগুলোতে প্রত্মতাত্ত্বিক স্থান খননের উম্মোচিত স্থাপত্যসমৃদ্ধ ধ্বংসাবশেষের ভূমি-নকশা, ধাতু লিপি ফলক, প্রাচীন মুদ্রা, মৃন্ময় মুদ্রক-মুদ্রিকা, পোড়া মাটির ফলক, ব্রোঞ্জ মূর্তি, পাথরের মূর্তি, লোহার পেরেক, পাথরের গুটিকা, অলংকারের অংশ এবং ঘরে ব্যবহৃত মাটির হাড়ি পাতিল প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে, পাথর ও ব্রোঞ্জমূর্তি। যেমন- লোকোত্তর বুদ্ধ মূর্তি, ত্রি-বিক্রম বিষ্ণুমূর্তি, তারা মূর্তি, মারীছী মূর্তি, মঞ্জুরের মূর্তি, পার্বতী মূর্তি, হরগৌরীমূর্তি, নন্দী মূর্তি, মহিষমর্দিনী মূর্তি, মনসা মূর্তি, গনেশ মূর্তি, সূর্যমূর্তি, হেরুক মূর্তি এবং ব্রোঞ্জের বজ্রসত্ত্ব মূর্তি।
জাদুঘরটিতে রয়েছে ব্রোঞ্জের তৈরী বিশালাকায় একটি ঘন্টা। যার ওজন ৫শ’ কেজি। এর ব্যাস ০ দশমিক ৮৪ মিটার এর উপরের বেড়িসহ উচ্চতা ০ দশমিক ৭৪ মিটার।
এ জাদুঘরের আধারে সুরক্ষিত রয়েছে ময়নামতিতে পাওয়া স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা। পোড়ামাটির ফলক। ব্রোঞ্জ ও তামার তৈরী সামগ্রী। লোহার তৈরী সামগ্রী। মাটির তৈরী বিভিন্ন প্রকারের খেলনা। কাঠের কাজের নিদর্শন। তুলট কাগজে লেখা প্রাচীন হস্তলিপি। বিভিন্ন নমুনার মৃৎপাত্র ইত্যাদি।
ব্লু ওয়াটার পার্ক
পার্ক বলতেই বিভিন্ন পশুপাখির মূর্তি এবং অবান্তর বিষয়াদিতে একাকার হয়ে থাকে। ম্যাজিক প্যারাডাইস'সহ অন্যান্য পার্কগুলোকে থেকে বাছাই করে আমরা ব্লু ওয়াটার পার্ককে (Blue Water Park) নির্বাচন করি। ময়নামতি জাদুঘর থেকে আমরা চলে আসি ব্লু ওয়াটার পার্কে। পার্কের মাঠে দুপুরের খাবার এবং যোহরের নামাজ শেষে শুরু হয়ে যায় পার্ক যজ্ঞ।
পার্কের ০৯টি রাইডের মধ্যে একটি হুইল ট্রেন, একটি মেরি-গো-রাউন্ড, কয়েকটি ওয়াটার বাস,সুইমিং স্পেস'সহ বেশ কয়েকটি চাকা-ভিত্তিক রাইড রয়েছে। এখানে টিকিটের দাম তুলনামূলক বেশি। প্রবেশের জন্য ৫০.০০ টাকা এবং প্রতিটি রাইডের জন্য ৪০/৬০/৪০০/১২০টাকা (এভারেজ)। প্রতিদিন প্রায় ১,০০০/১৫,০০ দর্শনার্থী পার্কটি দর্শন করতে আসে।
আমাদের ছাত্রদের এভারেজ ০৫ এটি রাইডে অংশগ্রহণ এবং সুইমিংপুলে নামার ব্যাবস্থা করেছি। দীর্ঘ সময় এখানে কাটিয়ে আমরা চলে আসলাম "বৃক্ষ জাদুঘরে"।
বৃক্ষ জাদুঘর
০৫ টাকার টিকেট কেটে জানা-অজানা প্রায় অসংখ্য গাছপালা দেখে গাড়িতে চেপে বসলাম। অবশেষে ক্লান্ত শরীরে প্রফুল্লচিত্তে ছাত্র শিক্ষক নিয়ে সাঁই সাঁই বেগে গাড়ি ছুটে চলছে মাদ্রাসার পানে।ছোটবেলা থেকেই দেশ-বিদেশ প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং অপরিচিত স্থানে ঘোরাফেরা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমার ক্ষুদ্র জীবনে ছাত্রদের নিয়ে প্রথম শিক্ষা সফর স্মরণীয় থাকবে। আজকে অনেক লিখেছি। শেষ পর্যন্ত যারা পড়েছেন সবাইকে ভালোবাসা জানিয়ে আজকে এ পর্যন্ত'ই। দোয়ায় রাখবেন, ফি-আমানিল্লাহ।