মিলাদ মাহফিল ও ইনসাফের কথা
মিলাদ মাহফিল আয়োজন ইবাদতে মাকসুদা তথা মৌলিক ইবাদত নয়। এটা গাইরে মাকসুদা হিসেবে বিভিন্ন সাওয়াবের কাজ ও ইবাদত পালনের সিস্টেম যেমন (তিলাওয়াত, দুরুদ, সালাম, নবীজীর জীবনীর আলোচনা, মেহমানদারী)। যেমনটা বিভিন্ন মাহফিল, সম্মিলিত মুনাজাত, তাসাউফের নির্দিষ্ট আমল ওজীফায় করা হয়। সেখানে মূল কাজগুলো ইবাদত কিন্তু নির্দিষ্ট সিস্টেম ফলো করা মুবাহ বিষয়। উলামায়ে কিরাম এভাবেই এর মূল্যায়ন করেছেন। এখানে শরীয়তে নতুন কোনো ইবাদত সংযোজন করা হয়নি।
যেকোনো নতুন বিষয় মানেই বিদয়াত নয়। নতুন বিষয় হলো মাসকুত আনহু তথা দলীল আসেনি এমন বিষয়। এটা নিয়ে শরয়ী মূলনীতির আলোকে আলোচনা হবে। শরয়ী নীতিমালার আলোকে বৈধ হলে বৈধ আর অবৈধ হলে অবৈধ। তবে নতুন বিষয়ের বিধান নিয়ে সে আলোচনায় মতভেদ হতে পারে। আল্লামা তাকী উসমানী হাফি তার মাকালাতে উসমানীতে খুব ইনসাফ করে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। যদিও তিনি মিলাদুন্নবী পালন করেন না কিন্তু কিছু শর্ত সহ আহলে ইলমের পালনের মতকে মূল্যায়ন করেছেন।
বিদয়াত বিষয়ে তো মতভেদ হতে পারে। বিদয়াত ভাগ হবে কিনা মতভেদ হয়েছে। সালাফের যুগে ইমাম শাফেয়ী রহ, বিদয়াতের প্রকারভেদ করেছেন। আমাদের বড় বড় ইমামদের থেকে এ প্রকারভেদ প্রমানিত। আলবিদয়াতুল ইদাফিয়াহ তে বিশাল আলোচনা এসেছে। তবে নবীজী ﷺ যে বিদয়াতের নিন্দা করেছেন সেটি আমাদের কাছেও বিদয়াত। দ্বীন নয় এমন বিষয়কে দ্বীন বানানো আপত্তিকর বিষয়। মিলাদ মাহফিলে দ্বীনের বহির্ভূত বিষয় আনা হয়নি বরং শরীয়তের ইবাদতই পালন করা হয়। মানে আমলগুলো ইবাদত হলেও আয়োজনের এ সিস্টেমটাকে আমরা ইবাদত বলি না।
তো বিদয়াতের মাসয়ালায় শাফেয়ী ও মালেকীদের আলোচনা বেশী দেখা যায়। মালেকীদের মধ্যে ইমাম ফাকেহানী, ইবনুল হাজ, শাতিবী রহ, কিছুটা কঠোর অবস্থানে ছিলেন। অপরদিকে শাফেয়ীরা ইমাম শাফেয়ীর অনুসরনে শরয়ী মূলনীতির আলোকে বিদয়াতকে ভাগ করতেন। এখান থেকে পুরো উম্মতের অধিকাংশরাই শাফেয়ীদের মানহাজে আলোচনা করে আর সালাফী ও দেওবন্দীরা মালেকী মানহাজে আলোচনা করে। যদিও তাসাউফের বিভিন্ন বিষয়ে দেওবন্দীরা নিজেদের কঠোর মূলনীতিতে আটকা পড়ে যায়। আর সালাফীরা ইমাম শাতেবী ও ইবনুল হাজকে আকীদাগত কারনে গোমরাহ অ্যাখ্যা দেয়।
তো জমহুর উম্মতের বাইরে এ মাসয়ালায় সালাফী ও দেওবন্দীদের কঠোরতা আমরা সমর্থন করি না। দেওবন্দের কঠোরতা হয়ত চরম বিদয়াতে লিপ্তদের জন্য বাস্তব হতে পারে কিন্তু আমভাবে এ অবস্থান গ্রহনযোগ্য নয়। বিশ্বের সালাফী ও দেওবন্দী ছাড়া বাকি মাযহাবী ও আশয়ারী মাতুরীদী সবাই মিলাদুন্নবী উদযাপন বৈধ মনে করে, সবার সিস্টেম একরকম নয়। সিস্টেম জরুরিও নয়। শরীয়া বিরোধী কিছু না হলেই হলো। যখন থেকে চালু হয়েছে তখন হতেই জমহুর এর পক্ষ । ইমাম ইবনু দিহইয়া, আবু শামাহ, ইবনু হাজার আসকালানী, সূয়ুতী, সাখাবী, হায়তামী, মোল্লা আলী কারী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ, আবদুল হক দেহলভী, সবাই এটা উদযাপনের পক্ষে।
এমনকি এ সময়ের আহলুস সুন্নাহর বড় আলিমদের দৃষ্টি ভংগিও এরকম। ইমাম যাহিদ কাউসারী, শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, মুহাম্মাদ আলাবী, শায়খ আওয়ামা, শায়খ আব্দুল্লাহ গুমারী, আলী জুমুয়া, সাইফ আলী আসরী, হামযা বাকরী, সাইদ ফুদাহ, মুহাম্মদ আজহারী, নিদাল ইবরাহীম, আমীমুল ইহসান, শাইখুল আজহার গন, শরীফ হাতিম আওনী, চার মাজহাবের স্কলারগণ সবাই তো পক্ষে। সিরিয়া, মিশর, তিউনিসিয়া, মরক্কো, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া সহ মুসলিম বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো ও স্কলারগণ এটা পালন করে। দেওবন্দী আর সালাফী ছাড়া কয়জনের এর বিরুদ্ধে অবস্থান পাওয়া যাবে? একজনের কথায় খুব হাসলাম যে দেওবন্দ সালাফী এ মাসয়ালায় এক সুতরাং এ মাসয়ালায় বিরোধী পক্ষ সবাই শায তথা বিচ্ছিন্নতাবাদী। what a joke that is!!!
যাই হোক ঢালাও ফতোয়া না দিয়ে বাস্তবতার নিরীখে কথা বলতে হবে। আমরা উলামায়ে দেওবন্দের প্রতি শ্রদ্ধা রাখি, তাদের মতামত মূল্যায়ন করি, তাদেরও আমাদের মত মূল্যায়ন করা উচিত। পুরো উম্মতকে বিদয়াতী অ্যাখ্যা দিয়ে পার পাওয়া সম্ভব না। এতে নিজের নফসের উপরই যুলম হবে। আর যারা এর পক্ষে গিয়ে বাড়াবাড়ি ও ভ্রান্ত আকীদা জুড়ে দিয়েছে, তাদের ব্যাপারেও সাবধান থাকতে হবে। তারা বৈধ বিষয়টাকে নিন্দনীয় বানাচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা ইনসাফ করার তাওফিক দিন।
(দুই বছর আগের পুরনো লেখা পরিবর্তনসহ)
লিখেছেন মুহতারাম আবু বকর তাওহীদ