বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সেকুলারিকরণ' : প্রক্রিয়া ও বিভিন্ন পর্যায়।
সেকুলারাইজেশনের পর্যায়গুলো
মডারেশন > হিউমেন রাইটস > রিফরমেশন > লিবারেল সেকুলারিজম/মডার্নিটি > রেডিকাল সেকুলারিজম।
এবার আসুন, সবগুলো পর্যায়কে সংক্ষিপ্তাকারে ব্যাখা করি।
বাংলাদেশে ছেলেপেলেরা কলেজ পর্যন্ত 'মুসলমান' থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দুয়েক বছরের মধ্যেই পাল্টে যায়। আমি অনেককে চিনি, যারা মনে করতো 'মূলধারায়' গিয়ে বিপ্লব করে ফেলবে, তাদের নিয়ত শুধু দাওয়াতের। দুই-তিন বছর পরে দেখা যায়, দাওয়াত দূরে থাকুক, তাদের নিজেদের ঈমান-আখলাক নিয়েই টানাটানি লেগে যায়। মনে রাখবেন, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো 'সেকুলার' বানানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যম।
কীভাবে 'সেকুলার' বানানো হয়? প্রধানত দু'টি প্রক্রিয়ায় 'সেকুলার' বানানো হয়। মূলধারায় আপনি সবার সাথে মিশতে বাধ্য, ভিন্ন সংস্কৃতি-মেয়েদের সাথেও আপনাকে ঘনিষ্ঠ হতে হবে, নইলে 'সামাজিক স্ট্যাটাস' অর্জন করতে পারবেন না। অনেক সময় শিক্ষকদের উদ্যোগে/চাপে মিশতে হয়। মিশতে মিশতে একসময় আপনার রুচি-আবেগ-অনুভূতিগুলো 'তাদের' মতো হয়ে যাবে।
'সেকুলার' সমাজে গোনাহকেও মানবিক চাহিদা ও স্বাধীনতার অংশ মনে করা হয়, কাজেই সবার সাথে মিশতে মিশতে একসময় অনেক পাপকাজ আপনার 'রুচি-অভ্যাসে' পরিণত হবে। আপনার আর 'হুজুরদের' সাথে মিশতে ইচ্ছা করবে না। যে ছেলে-মেয়েটাকে আপনি জামাই/বৌ হিসেবে কল্পনা করবেন, সে ছেলে/মেয়ে আর 'হুজুর/নিকাবি' হবে না, সে হবে 'সেকুলার' সমাজ ও রুচির কোন একজন। অবশ্য অনেকের মধ্যে এত পরিবর্তন আসে না, তারা দ্বিধায় দুলতে থাকে সবসময়।
রুচি-বন্ধুমহল-অভ্যাসের সাথেসাথে তাদের যুক্তিব্যবস্থাতেও পরিবর্তন আসে। তারা পশ্চিমা 'অধিকার' ও 'স্বাধীনতা' প্রপঞ্চগুলোতে আগ্রহী হয়ে উঠে। তাদের যুক্তিগুলোও সেরকম হয়ে যায়। তাদের যুক্তিগুলোতে ক্রমবিবর্তন ঘটে যেভাবে :
ক) ‘ইসলাম সবার অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে’, শুরুতে তারা বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে এটা প্রমাণ করেন। তাদের আলোচনার শিরোনাম থাকে, ‘ইসলাম ও বিজ্ঞান।’ ‘আল কুরআনে বিজ্ঞান’। ‘বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান’। ‘ইসলামে নারীদের অধিকার।’ ‘ইসলামে সংখ্যালঘুদের অধিকার’। তারা পশ্চিমা ভাষা, বিষয়বস্তু, মেথডলজি ও কারেক্টনেস মেনে কথা বলতে চেষ্টা করেন, এই পর্যায়কে বলা যায় মডারেশন।
খ) পরবর্তীতে তারা ‘অধিকার’ ও ‘স্বাধীনতা’কেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তারা বলেন, প্রত্যেকে প্রত্যেকের 'অধিকার' ও 'স্বাধীনতা' অনুযায়ী চলুক। যে বোরকা পরতে চায়, সে বোরকা পরুক। যে বিকিনি পরতে চায়, সে তার অধিকার লাভ করুক। এই পর্যায়কে বলা যায়, ডেমোক্রসি, ফ্রিডম অফ রিলিজিয়ন এন্ড ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন।
গ) একসময় সে দেখতে পায়, ইসলামের অনেক বিধিবিধান পশ্চিমা অধিকার ও স্বাধীনতা কল্পনার সাথে যাচ্ছে না। সে বলতে চেষ্টা করে, মূলত হুজুরদের অপব্যখ্যার প্রেক্ষিতে ইসলামের সাথে আধুনিকতার সাথে সংঘর্ষ দেখা যাচ্ছে। সে ইসলামের নতুন ব্যাখ্যার কথা বলে, হুজুরদের 'কবল' থেকে ইসলাম রক্ষার আহবার জানায়। এই পর্যায়কে বলা যায়, রিফরমেশন পিরিয়ড। সে ‘মাদরাসার শিশুনির্যাতন’ নিয়ে অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠে। ধর্মীয় অথরিটি, প্রতিষ্ঠান ও ট্র্যাডিশন নিয়ে প্রশ্ন তুলে। ‘হুজুর’ ও ‘ধর্মীয় সমাজ’ নিয়ে ঠাট্টা শুরু করে।
ঘ) আপনি একসময় বুঝতে পারেন, সমস্যাটা আসলে হুজুরদের না। ইসলামের অনেককিছুকে আধুনিকতার সাথে মেলানো যাচ্ছে না। আপনি ভাবেন, ধর্মের জায়গায় ধর্ম থাকুক, অধিকার/রাজনীতির জায়গায় অধিকার/রাজনীতি থাকুক। এই পর্যায়ে আপনি লিবারেল সেকুলারে পরিণত হন। আপনি ভাবেন, ধর্ম মসজিদ-মাদরাসায় থাকুক। ধর্মীয় 'বিশ্বাস'কে কেন রাষ্ট্রের মধ্যে আসতে হবে? যে যার বিশ্বাস নিয়ে থাকুক। এই পর্যায়ে আপনি নিজের বিশ্বাস নিয়েই টানাপোড়েনে পড়ে যাবেন।
ঙ) পরবর্তীতে আপনার মনে হবে, ধর্মের মতো অযৌক্তিক বিষয় সমাজে কোনভাবে থাকতে পারে না। এতে মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হয়। বোরকা পরাটা নিছক অধিকার না, নারীরা কেন 'পর্দার' মধ্যে আটকে থাকবে, 'বোরকা' পরতে বলা পিছিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র। মাদরাসায় পরা মানেই 'কাল্পনিক জান্নাত-জাহান্নাম' এর ঘোরে ডুবে থাকা। নিকাব ও মাদরাসা দমনে আপনি শক্তি প্রয়োগেরও পক্ষে থাকবেন। আপনি ইতিমধ্যে 'ঈমান'হারা হয়ে গেছেন। এই পর্যায়কে বলা হয় রেডিকাল সেকুলারিজম।
সবাই সবস্তর পর্যন্ত নেমে যান না। পরিবেশ ও চিন্তাপ্রক্রিয়ার ভিত্তিতে একেকজনের একেক পর্যায়ের পরিবর্তন আসে। তবে আপনার আশেপাশে এমন অনেক দৃষ্টান্ত পাবেন। যদি বাবা 'খ' পর্যন্ত নেমে আসেন, তবে সাধারণত সন্তানদের আরও অবনতি ঘটে। সে 'গ/ঘ' তে নেমে যায়। এক প্রজন্মে সাধারণত কেউ 'ক' থেকে 'ঙ' নামতে পারে না।
সেকুলারিকরণ প্রক্রিয়া থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে, সবার সাথে প্রয়োজনের অতিরিক্ত না মেশা। পাশাপাশি সম্ভব হলে পাঞ্জাবি-পাজামা পরা, জামাতে নামাজ পড়া, তাবলীগে যাওয়া। পাশাপাশি চিন্তার হেফাজতও করতে হবে। দেখা যায়, অনেকে পাঞ্জাবি-পাজামা পরেন ঠিকই, ঐদিকে তাদের চিন্তা বেদখল হয়ে যায়।
দেখুন, আপনি খারাপ, এটা আমি মোটেই বলছি না। অধিকাংশ মানুষ পরিবেশের প্রভাব থেকে বাঁচতে পারে না। আমি/আমরাও ফেরেশতা না, আপনার জায়গায় আমি/আমরা থাকলে আমাদের প্রায় সবার একই পরিণতি হবে।
লিখেছেন: ইফতিখার জামিল হাফিঃ