ছতুরা দরবার শরীফ এর পরিচিতি
ছতুরা দরবার পরিচিতি ও অবস্থান:
দ্বীনের খেদমতে আজীবন সংগ্রাম করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত দূর্গম অঞ্চলে পায়ে হেটে ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সাধারণ মানুষের কাছে ত্বরীকত, তাছাউফের তালীম তাওয়াজ্জুহ ও দ্বীনের দাওয়াত প্রচারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার ছতুরা দরবার শরীফের কুদওয়াতুছ ছালেকীন, জুবদাতুল আরেফীন, কুতুবুল ইরশাদ পীর প্রফেসর আবদুল খালেক রহ. ছিলেন অগ্রগামী। তিনি ১৯২৮ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ভারতে, ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে এবং ১৯৫২ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ঢাকা-ময়মনসিংহ, মুন্সীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ফেনী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব, নরসিংদী এলাকায় নিরলসভাবে ইসলামের প্রচার প্রসার ও দ্বীনের খেদমতে কাজ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
{getToc} $title={Table of Contents}
ছতুরা দরবারে যাওয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা:
বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে বাস বা ট্রেন যোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ২০ কি.মি. দক্ষিণে তন্তর বাস স্ট্যান্ড নেমে আধা কি.মি. পশ্চিমে ছতুরা দরবার শরীফ।
ছতুরা দরবারের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান পরিচালক:
কুদওয়াতুস সালেকীন, জুবদাতুল আরেফীন, কুতবুল ইরশাদ, আলহাজ্ব শাহছুফি প্রফেসর আল্লামা মাওলানা আব্দুল খালেক র. এম, এ (ফারসী ও আরবী) ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসের বুধবার এক শুভলগ্নে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত আখাউড়া উপজেলার ছতুরা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।
নিজ গ্রামের মক্তবে পবিত্র কুরআন মাজীদ ও ফারসী ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। কুমিল্লা হুচ্ছামিয়া মাদরাসা থেকে ১৯১৩ সালে সর্বোচ্চ ডিগ্রী জামায়াতে উলা (ফাযিল) পরীক্ষায় ফার্স্ট হন। পরবর্তীতে ১৯১৪ সালে কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালা হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯১৮ সালে এন্ট্রান্স (এস.এস.সি) পাশ করেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯২০ সালে এফ.এ. (এইচ.এস.সি), ১৯২২ সালে উক্ত কলেজ হতে কলকাতা ইউনিভার্সিটি'র অধীনে বি.এ (ডিগ্রী), ১৯২৫ সালে কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ফারসী ভাষা ও সাহিত্য'র ওপর এম.এ পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট পাচ ভরি ওজনের স্বর্ণের গোল্ড মেডালিস্ট, ১৯২৬ সালে পুনরায় কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে 'আরবী ভাষা ও সাহিত্য'র ওপর এম.এ পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট গোল্ড মেডালিস্ট।
আরও পড়ুন: মাগুরা দরবার শরীফের পরিচিতি
তিনি ১৯২৫ সালে ফেনী কলেজে আরবী ফারসী ভাষা ও সাহিত্যে'র লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯২৭-২৮ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী'র নির্দেশে তিনি কলকাতা লেডী ব্র্যাবোর্ন কলেজে প্রফেসর হিসেবে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। দেশভাগের পর তিনি বর্তমান বদরুন্নেছা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ও ইডেন গার্লস সরকারী কলেজে ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯২৫ সালে পীরে কামেল আলহাজ্ব শাহসূফী হযরত মাওলানা ছদর উদ্দিন আহমদ র. এর নিকট প্রথম বায়াত গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে মুজাদ্দেদে যামান ইমামুত ত্বরীকত আমীরুশ শরীয়াত আলহাজ্ব শাহসূফী হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিকী র. এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। প্রফেসর আল্লামা আব্দুল খালেক র. উভয় পীরের নিকট থেকে কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া, মুজাদ্দেদীয়া, মুহাম্মাদীয়া, ওয়েসীয়া, সোহরাওয়ার্দীয়াসহ বহু তরীকার যাবতীয় সবক শেষ করেন এবং খেলাফত প্রাপ্ত হন। ২ এপ্রিল ১৯৫৫ ইং ১৯ চৈত্র ১৩৬১ বাংলা ৮ শাবান ১৩৭৪ হিজরি রোজ শনিবার তিনি ইন্তেকাল করেন। তার মাজার ছতুরা দরবার শরীফে।
প্রফেসর আবদুল খালেক রহ এর ইন্তেকালের পর দরবারের দায়িত্ব পালন করেছেন পীরজাদা আবু আহমদ মোবাশশির হোসেন কাওসার রহ.। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন প্রফেসর আবদুল খালেক রহ এর নাতী মোহাম্মদ আশিক হোসাইন হাফি: তিনি পিতা ও দাদার দাওয়াতী মিশন নিয়ে এগিয়ে চলছেন।
ছতুরা দরবারের উল্লেখযোগ্য উলামায়ে কেরাম:
শাহ সুফী আলহাজ্ব বোরহান উদ্দিন (রহঃ), শাহ্ সুফি খন্দকার আবদুল জব্বার (রহ), শাহ্ সূফি অধ্যাপক এ এফ এম আবদুল আজিজ (রহ), শাহ সূফি জমির উদ্দীন (রহ:),শাহ সুফী আলহাজ্ব আবদুস সোবহান (রহঃ), শাহ সুফী ফতেহ্ আলী ওরফে ফাতের মাষ্টার (রহঃ), শাহ সুফী আলহাজ্ব আবদুল হান্নান (রহঃ), শাহ সুফী আলহাজ্ব হাফেজ হাবিবুর রহমান (রহ), শাহ সুফী আলহাজ্ব গোলাম মাওলা আখন্দ (রহঃ),শাহ সুফী দীন মোহাম্মদ (রহঃ)শাহ সুফী নুরুল হক (রহঃ)।
ছতুরা দরবারের আকিদা:
ছতুরা দরবার শরীফ সূচনালগ্ন থেকেই পরিপূর্ণ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী। মাযহাবে হানাফীর ধারক ও বাহক। তরিকায়ে কাদেরীয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, মোজাদ্দেদীয়া, মুহাম্মদীয়ার প্রচার প্রসার, তালিম তাওয়াজ্জুহ, সবকাদি মশক করিয়ে থাকেন।
ছতুরা দরবারের খেদমতসমূহ:
প্রফেসর আবদুল খালেক রহ ছিলেন বহু প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন একাধারে মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকীহ, আদিব, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক ও আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানী।
তিনি ছিলেন আরবী, ফারসী, উর্দু, ইংরেজী, হিন্দী, হিব্রু সহ পৃথিবীর বহু দেশের বহু ভাষার পণ্ডিত। তিনি ইংরেজী ভাষায় পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করে উপমহাদেশে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তৎকালীন পাকিস্তানে “তালীমাত-ই-ইসলামিয়া বোর্ড” নামে শরীয়তের আইন খসড়াকারী বোর্ডে তিনি দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে পার্লামেন্ট নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর দক্ষিণাঞ্চল, কসবা ও আখাউড়া থেকে তিনি এম.এল.এ (এম.পি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে স্বেচ্ছায় ইস্তফা দেন। এছাড়াও তিনি অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ ও লিখনীর মাধ্যমে ইসলামের খিদমত করে গেছেন।
তিনি যেমন ইলমে জাহেরীতে পারদর্শী ছিলেন তদ্রূপ ইলমে বাতেনীতেও পরিপূর্ণ ছিলেন। অসংখ্য জেনারেল শিক্ষিত মানুষ তার হাতে বায়াত হয়ে মহান প্রভুর মারিফাত অর্জন করেছেন।
আরও পড়ুন: সিলসিলায়ে ফুরফুরা শরীফ এর পরিচিতি ।
ছতুরা দরবার শরীফ কর্তৃক অজিফা:
প্রফেসর আবদুল খালেক রহ ছালেকদেরকে নিম্ন অজিফা নিয়মিত বাদ ফজর ও মাগরিব পাঠ করার জন্য তাগিদ দিতেন।
[ জুবদাতুল আরেফীন ওজিফাতুছ ছালেকীন, পীরজাদা আবু আহমদ মোবাশ্বের হোসেন(আবু কাউসার) রহ. পৃষ্ঠা: ২৯-৪১]
০১). সাইয়্যেদুল ইস্তিগফার: ১বার।
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৮৬৭
সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩৮৭২;
আবু দাউদ, ৫০৭০;আহমদ, ২২৫০৪)
০২.) ১ বার اية الكرسى (আয়াতুল কুরসী)
(সুনানে কুবরা নাসাঈ হাদীস নং-৯৯২৮/ ইবনুস্ সুন্নী হাদীস নং-১২৩)
০৩).০৭ বার- আল্লাহুম্মা আজিরনি মিনান নার।
০৪.) সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত- ০১ বার।
০৫). ৩ বার-
أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللِّٰه التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
(মুসলিম, তিরমিজি)
০৬). ৩ বার-
بِسْمِ اللهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ العَلِيمُ
(তিরমিজি, ৩৩৮৮;ইবনু মাজাহ, ৩৮৬৯;আহমদ,৪৪৮,৫২৯)
০৭). ৭ বার-
رَضِيْتُ بِاللهِ رَبًّا وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ نَبِيًّا وَرَسُوْلاً.
(আবু দাউদ হাদীস নং-৫০৩৩/তিরমিযী হাদীস নং-৩৩৮৯/মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৭৭৮)
০৮). দশবার- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মালিকুল হাক্কুল মুবীন।
০৯). ৭ বার।
حَسْبِيَ اللهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرشِ العَظِيْمِ.
১০). ১ বার-
اللهم إني أسألك بأني أشهد أنك أنت الله الذي لا إله إلا أنت.
الأحد الصمد الذي لم يلد ولم يولد، ولم يكن له كفوا أحد.
১১). ৩ বার -
سُبْحانَ اللهِ وبِحَمْدِهِ، سُبْحانَ اللهِ العَظِيمِ.
(সহিহ বুখারী, ৬৬৭২)
১২) ১৯ বার -
بسْمِ اللهِ الرَّحمَنِ الرَّحِيمِ
১৩). ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ৩৪বার আল্লাহু আকবর (মুসলিম হাদীস নং-৫৯৫)
১৪) ১বার-
اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ
(আবু দাউদ হাঃ ১৫২২; নাসায়ী কুবরা: ৯৮৫৭)
১৫) ১০ বার -
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ. لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ .
(ইবনুস সুন্নী হাদীস নং-১৩৭,১৩৬; বুখারী হাদীস নং-৮০৪/৮৪৪ ও ৫৮৯১)
১৬) ১০ বার-
সুবহানাল্লাহি, ওয়াল আলহামদুলিল্লাহি, ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার।
১৭) ১০ বার-
সুবহানাল মালিকিল কুদ্দুস।
১৮) ১০ বার-
সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালায়িকাতি ওয়াররুহ।
১৯) ১০ বার-
لا حول ولا قوة إلا بالله، ولا ملجأ، ولا منجي من الله إلا إليه.
২০) ১০ বার-
يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيثُ-
২১) ২৫ বার- আল্লাহুম্মা বারিকলী ফিল মাওত, ওয়াফিমা বা'দাল মাওত।
২২) ৮ বার- আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা রিদাকাল জান্নাহ।
২৩) সূরা ইখলাস ৩ বার, সূরা ফালাক ৩ বার, সূরা নাস ৩ বার।
২৪) ছওয়াব রেসানী-
ইস্তেগফার বেজোড় সংখ্যায় কয়েকবার। বিসমিল্লাহসহ সূরা ফাতিহা ৩ বার। বিসমিল্লাহসহ সূরা ইখলাস ১০ বার। দরুদ শরীফ ১১ বার।
দুই / চার রাকাত ইশরাকের নামাজ। (সুনানু তিরমিযি-৫৮৬, সুনানু তিরমিযি-৪৭৫)
সলাতুত দুহা বা চাশতের নামাজ। (সহীহ মুসলিম-৭১৯)
বাদ মাগরিব দুই দুই রাকাত করে ছয় রাকাত আউয়াবিন নামাজ। (ইবনে মাজাহ, ১১৬৭)
জিকির।
বাদ এশা দরুদ শরীফের আমল।
সন্ধায় সূরা ওয়াকিয়া, বাদ এশা সূরা মুলক তিলাওয়াত করা।
ছতুরা দরবারের প্রকাশিত গ্রন্থাবলি:
০১. সাইয়েদুল মুরসালীন ১ম,২য়,৩য়; ০২. সিরাজুস সালেকীন।০৩. মুনাব্বেহাত(অনুবাদ)। ভারতের কলকাতায় অধ্যাপনা কালীন সময়ে তাঁর আরবী, ফারসী, উর্দু, বাংলা ভাষায় রচিত নিম্ন লিখিত কিতাব সমূহ কলকাতা শিক্ষা বোর্ড ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক বিভিন্ন শ্রেণীতে পাঠ্যপুস্তক রূপে ছিল। যেমন : গুনচা-ই-ফারসী প্রথম খণ্ড- হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীর জন্য, দুররাতুল আদাব দ্বিতীয় খণ্ড- হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীর জন্য, সরল আরবী ব্যাকরণ- সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর জন্য। এছাড়া তাঁর লিখিত বহু কিতাবের পাণ্ডুলিপি আজও অপ্রকাশিত রয়েছে।