ইতিবাচক দেওবন্দ, নেতিবাচক দেওবন্দ
দেওবন্দি সিলসিলা ধর্মীয় নেতৃত্ব-প্রাতিষ্ঠানিকতায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার আগে, মাদরাসাগুলো পরিচালিত হত প্রধানত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, জমিদার-ভূস্বামীরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করতেন। ঢাকার মাদরাসার মানে ঢাকার নবাব-জমিদারদের মাদরাসা, কাজেই মাদরাসাগুলো সাধারণত নবাব-জমিদার পরিবারের সিদ্ধান্ত-রাজনীতি-সংস্কৃতির বাইরে যেত পারত না। নবাব-জমিদারদের পতনের সাথে সাথে মাদরাসার দরজাগুলোও বন্ধ হয়ে যেত।
ব্রিটিশদের অব্যাহত হস্তক্ষেপে মোগল শাসক-জমিদারদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যায়। একপর্যায়ে, শাসক-জমিদাররা কোম্পানি-রাষ্ট্রীয় বেতনে জীবন যাপন করতেন। তাদের পক্ষে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা-পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। যারা নিজেরাই অন্যের মুখাপেক্ষী, তারা কীভাবে মাদরাসা চালানোর বিলাসিতা দেখাতে পারেন? যারা সেনাবাহিনী পালতে পারছেন না, তারা কীভাবে হুজুর-শায়েখদের আশ্রয় দিবেন? এই প্রেক্ষাপটে দেওবন্দি আলেমরা নতুন ধর্মীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
এই নতুন উদ্যোগে আলেমরা নিজেরাই নিজেদের পৃষ্ঠপোষকতা করবেন, মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। জনতাকে দেখাবেন নতুনদিনের স্বপ্ন। জনতা স্বপ্নের সন্ধানে আলেমদের উদ্যোগে অর্থায়ন করবেন। অবশ্য শুধু জনতাই নয়, দেওবন্দের বাৎসরিক প্রতিবেদনগুলো দেখলে ধরতে পারবেন, সরকারি চাকরিজীবী-ধনী ব্যবসায়ীরাই প্রধানত ধর্মীয় উদ্যোগগুলোতে অর্থায়ন করেন। এখানে গ্রামীণ জনতার অংশগ্রহণ ছিল সামান্যই। এই নতুন ধর্মীয় উদ্যোগের প্রেক্ষিতে ইলমি সংস্কৃতিতে দুটি বড় রকমের পরিবর্তন সৃষ্টি হয়।
আলেমরা উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, পাশাপাশি গবেষণা ফান্ড বন্ধ হয়ে যায়। এই দুই পরিবর্তনের প্রভাব অপরিসীম। এই দুই পরিবর্তন ধরতে না পারলে কখনোই বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার আলেম সমাজের গতি-প্রকৃতি বুঝতে পারবেন না। দক্ষিণ এশিয়ায় বড় আলেম কারা? বড় উদ্যোক্তা মানেই বড় আলেম। আপনার বড় প্রতিষ্ঠান আছে, আপনার অনুসারী-ছাত্রসংখ্যা বেশী, কাজেই আপনিই সবচেয়ে বড় আলেম। এভাবে আলেমের প্রচলিত সংজ্ঞায় বড় রকমের রদবদল ঘটে।
আরও পড়ুন: আলেম-ইসলামপন্থীরা কেন রাজনীতিতে ব্যর্থ?
এই রদবদলের পাশাপাশি অর্থায়নের ক্ষেত্রেও বেশকিছু পালাবদল ঘটে। আগে রাষ্ট্র-জমিদাররা গবেষণা প্রকল্পে অর্থায়ন করতেন। ইবনে খালদুনের মুকাদ্দিমা বা গাজালির কথাই ধরুন, এই আলেমরা কীভাবে নিরিবিচ্ছিন্নভাবে ইলমি কাজে লেগে থাকতে পারতেন? তাদের গবেষণা প্রকল্পগুলোতে শাসক-রাষ্ট্র-জমিদাররা অর্থ বিনিয়োগ করতেন। ‘ধর্মীয় উদ্যোক্তা’রা আলেমে পরিণত হবার প্রেক্ষিতে/ আলেমরা ‘ধর্মীয় উদ্যোক্তা’য় পরিণত হবার প্রেক্ষিতে অর্থায়নগুলো প্রধানত চলে যায় ভবন তৈরি-শিক্ষক-ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনেই। কেননা যদি প্রতিষ্ঠানের ভবন বড় ও বেশী না হয়, ছাত্র-শিক্ষক যদি হাজারের ঘর অতিক্রম না করে, তবে আপনি কখনোই ‘বড় আলেম’ হতে পারবেন না।
এই পরিবর্তনকে যেমন নিছক নেতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ নেই, একইসাথে এককভাবে ইতিবাচকভাবে দেখাও কাম্য নয়। প্রতিটা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মতো এই পরিবর্তনকেও ধরতে জানতে হবে। এর সুদুরপ্রসারী প্রভাবকেও চিহ্নিত করতে হবে। দেওবন্দের উসুলে হাশতেগানা বা মূলনীতি অষ্টক ছিল তৎকালীন যুগচাহিদার অংশ, ঠিক এ কারণেই যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এখন কেউই আট মূলনীতির সবগুলো মেনে চলেন না, নিজেদের মতো কাটছাঁট করে নেন। দেওবন্দের মূলনীতি-প্রাতিষ্ঠানিকতাকে কেন্দ্র করে অনেক কল্পনা-রুপকথা প্রচলিত আছে। কে কাকে কীভাবে কখন কল্পনা-রুপকথা-গল্পগুলো বলছে, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহ উপকারী বস্তুকেই টিকিয়ে রাখেন, বাকি সবকিছুই সময়ের সাথে ভেসে যায় ও যাবে