সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি, কেন ও কীভাবে?

সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি, কেন ও কীভাবে?

মুসলিম হিসাবে আমাদের অন্তরে এ নিষ্কম্প বিশ্বাস অবশ্যই থাকতে হবে যে, পরিপূর্ণ আত্মসমরপণের মাধ্যমে লা-শরীক আল্লাহর একক ও নিরঙ্কুশ আনুগত্যই হলো ইসলামের মূলকথা তথা তাওহীদের সারনির্যাস। এমনকি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যও এজন্য অপরিহার্য যে, আসমানী ওহীর তিনি সর্বশেষ অবতরণক্ষেত্র এবং তাঁর জীবনের প্রতিটি আচরণ ও উচ্চারণ শরীয়তে ইলাহিয়ারই প্রতিবিম্ব।

সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি: কেন ও কীভাবে

সুতরাং দীন ও শরীয়তের ক্ষেত্রে আমাদেরকে আল্লাহ ও রাসূলেরই আনুগত্য করে যেতে হবে সমর্পিতচিত্তে, এখলাস ও একনিষ্ঠার সাথে। তৃতীয় কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে এ আনুগত্যের সামান্যতম হকদার মনে করারই অপর নাম হল শিরক। অন্যকথায় হালাল-হারামসহ শরীয়তের যাবতীয় আহকাম ও বিধি বিধানের ক্ষেত্রে কোরআন ও সুন্নাহই হলো মাপকাঠি। আর এদুয়ের একক আনুগত্যই হলো ঈমান ও তাওহীদের দাবি। এ বিষয়ে ভিন্নমতের কোনও অবকাশ নেই। 

তবে একটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, কোরআন ও সুন্নাহয় বর্ণিত বক্তব্য ও আহকাম দুধরনের। 

১. কিছু আহকাম যাবতীয় বাহ্যবিরোধ, অস্পষ্টতা ও সংক্ষিপ্ততামুক্ত এবং সেগুলোর উদ্দেশ্য ও মর্ম এতই স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট যে, বিশিষ্ট, সাধারণ সকলের পক্ষেই নির্ঝন্ঝাটে তা অনুধাবন করা সম্ভব। 

২. পক্ষান্তরে কোরআন ও সুন্নাহয় এমন কিছু বিষয় আপনি পাবেন, যেগুলোর মধ্যে বাহ্যবিরোধ, অস্পষ্টতা ও সংক্ষিপ্ততা রয়েছে। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া সেগুলোর সঠিক অর্থ ও মর্ম অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

 

যেমন- আল্লাহ তাআলার ইরশাদ- أَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآَتُوا الزَّكَاةَ  অর্থ: নামাজ কায়েম করো, যাকাত প্রদান করো। কিন্তু কীভাবে নামাজ কায়েম করবে এবং কী পরিমাণ সম্পদ থেকে কতটুকু প্রদান করবে, তার কোন ব্যাখ্যা কোরআনে নেই। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় আমল ও বাণীর মাধ্যমে উভয়ের ব্যাখ্যা প্রদান করলেন। এ থেকে বুঝা গেলো, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম মহান দায়িত্ব ছিলো আমল ও বাণীর দ্বারা কোরআনে কারীমের ব্যাখ্যা প্রদান করা। তাঁকে ব্যাখ্যাদানের দায়িত্ব অর্পণ করে আল্লাহ পাক বলেন—


وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ


অর্থ: আপনার কাছে আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি লোকদের সামনে ঐসব বিষয় বিবৃত করেন, যেগুলো তাদের প্রতি (আপনার মাধ্যমে) নাযিল করা হয়েছে। 


সারমর্ম দাঁড়ালো, পবিত্র কোরআনের সংক্ষিপ্ত বাণীসমূহের ব্যাখ্যা হলো রাসূলুল্লাহর তৎসংশ্লিষ্ট আমল ও বাণী। এবং হাদীস বা সুন্নাহর মধ্যে এক বিশাল ভাণ্ডার হলো কোরআনে কারীমের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। এ কারণেই বুখারী-মুসলিমসহ প্রায় হাদীসের কিতাবে كتاب التفسير নামে একটি অংশ রয়েছে।


আমরা জানতে পেরেছি যে, কোরআনের সংক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট ইরশাদসমূহের ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাখ্যা গ্রাহ্য হয়। এখন আমরা যদি এমন কোন হাদীস বা আয়াত পাই, যার মধ্যে রয়েছে অস্পষ্টতা ও সংক্ষিপ্ততা, যার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আমরা হাদীসে পাই না। তাহলে এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী? 


এক্ষেত্রে দুটি পন্থা হতে পারে। ১. প্রত্যেকে নিজেদের মত ব্যাখ্যা করে তদানুযায়ী আমল করা অর্থাৎ নিজেদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উপর ভরসা করে নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

২. অথবা কারো পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা গ্রহণ করে তাদের অনুসরণ করা? আবার যাদের অনুসরণ করবো, তাদের অনুসরণ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য কতটুকু? 

নাকি

তৃতীয় আরেকটা পন্থা হতে পারে যে, এমন আয়াত বা হাদীসের উপর আমল না করা।

 এটা স্পষ্ট যে, আমল না করার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং আমাদের সামনে দু’টি পথ।


• প্রথমত, হয়তো নিজেদের ব্যাখ্যা মতে আমল করবো। 

• দ্বিতীয়ত, নয়তো কারো ব্যাখ্যা মেনে নিয়ে তাদের অনুসরণ  করবো। প্রথমটা নিয়ে আলোচনা পরে করব।


• এখন দ্বিতীয় ছুরত নিয়ে আলোচনা করছি—

পূর্বে একথা উলে­খ হয়েছে যে, পবিত্র কোরআনে কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উপর কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের-ই অনুসরণ করা ফরয; অন্য কারো নয়। 


তবে কোরআনে কারীমে এমনও আয়াত পাওয়া যায়, যার মধ্যে সুস্পষ্ট ভাষায় একটি দলের অনুসরণের উপর আল্লাহ তাআলা দুটি সুসংবাদ দান করেছেন- (এক) আল্লাহ পাকের রেযামন্দি। (দুই) জান্নাতপ্রাপ্তি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ. 


অর্থ: অগ্রগামী মুহাজির ও আনসার সাহাবাগণ এবং যে সমস্ত মুসলমান নিষ্ঠার সাথে তাঁদের অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। আর তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কাননকুঞ্জ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় প্রস্রবণসমূহ। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এটাই হল মহান কৃতকার্যতা। (সূরা তাওবা, আয়াত নং-১০০)


উক্ত আয়াতে মুহাজির ও আনসার সাহাবায়ে কেরামের পূর্ণরূপে অনুসরণকারীদের দুটি সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। ১.খোদার রেযামন্দি। ২.জান্নাত প্রাপ্তি। 


পক্ষান্তরে সাহাবায়ে কেরামের তরীকার অনুসরণ না করে ভিন্ন পথ অবলম্বনকারীকে পরকালে জাহান্নামী হওয়ার হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আল্লাহ পাক বলেন—


وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا.  


অর্থ: যে কেউ রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে তার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং মুমিনদের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাবো, যে দিক সে অবলম্বন করেছে, এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থল। (সূরা নিসা, আয়াত নং-১১৫)


এ আয়াতে কারীমায় মুমিনদের দ্বারা উদ্দেশ্য সাহাবায়ে কেরাম। দেখুন—

تفسير المظهري ২/২৩৬، روح المعانى ৩/২০২، بهجة النفوس لأبى جمرة ১/৪، مقدمة الجرح والتعديل لأبى حاتم ৭، اختلاف امت اور صراط مستقيم ১৫.


এখন প্রশ্ন হলো, উক্ত আয়াতে কারীমায় “রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে” এতটুকু বলাই যথেষ্ট ছিলো। এর সাথে “মুমিনদের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে” বাক্যটি যোগ করার কী প্রয়োজন দেখা দিলো? কেননা ইসলামী শরীয়ত তা-ই, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসেছে। কাজেই দীন-ইসলাম তা-ই, যা রাসূল   করেছেন বা বলেছেন। সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করলে জাহান্নামী হওয়ার কারণ হতে পারে। 


কিন্তু আল্লাহ যে বললেন মুমিনদের পথের উল্টা পথে চললে জাহান্নামী হতে হবে। কেন এমন বললেন? তার কারণসমূহের মধ্যে একটি হলো- উভয় বাক্যর মাঝে ব্যাখ্যাবাচক যোগসূত্র রয়েছে। অর্থাৎ কোরআন-হাদীসে এমন কিছু বিধি-বিধান পাওয়া যাবে, যার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে হাদিসে পাওয়া যাবে না। 


কিন্তু মুমিনদের এক জামাআতের কথা ও কাজের মধ্যে, সেগুলোর রাসূল প্রদত্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে। এ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ায় এবং কেউ যেন এটাকে ভ্রান্ত বা অগ্রহণযোগ্য মনে না করে, সে জন্য আল্লাহ পাক দ্বিতীয় বাক্যটি সংযোগ করে দিয়েছেন। 


আর রাসূল প্রদত্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ একমাত্র জামাআতে সাহাবার পক্ষে সম্ভব। কারণ তারা নবীজীকে এমন বলতে শুনেছেন বা করতে দেখেছেন অথবা এমন করার উপর রাসূলের পক্ষ থেকে সম্মতি পেয়েছেন। যার ফলে তাঁরা এমন বলেছেন বা করেছেন। সুতরাং এ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পরিহার করার অর্থ হলো রাসূলের আনীত রাস্তা থেকে বিচ্যুত হওয়া, যা জাহান্নামে নিক্ষেপের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। 


উলে­খ্য, আয়াতে কারীমায় “মুমিনীন” শব্দকে যদি সাহাবাদের সাথে খাছ না করে ব্যাপক রাখা হয়, তখন মুমিনীন থেকে উদ্দেশ্য ইজমায়ে উম্মত, যা অনেক মুফাসসির ও ওলামায়ে কেরাম বলেছেন। তখন আয়াতের মর্ম দাঁড়াবে, কোন বিষয়ে যদি উম্মতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তা অনুসরণ না করে ভিন্ন পথ অবলম্বনকারী জাহান্নামী হবে। 


পাঠকবৃন্দ! মনে রাখবেন, প্রথম আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁদের অনুসরণের উপর সুসংবাদ এবং দ্বিতীয় আয়াতে তাদের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলার উপর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তার অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে বাদ দিয়ে তাদের অনুসরণ করবো। 


বরং তার অর্থ হচ্ছে এই, যে সমস্ত হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে আল্লাহ বা রাসূলের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে, সেখানে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের-ই অনুসরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোন ছাড় নেই। হ্যাঁ, যে সমস্ত হুকুম-আহকামে রাসূলের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, সেক্ষেত্রে নিজেদের ব্যাখ্যা মতে আমল না করে তাঁদের অনুসরণ করলে উক্ত সুসংবাদদ্বয়ের হকদার হওয়া যাবে এবং যাওয়া যাবে জান্নাতে। এ অর্থই এখানে উদ্দেশ্য। 


এ পর্যায়ে এসে সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণের ব্যাপারে আরো দুটি আয়াত পেশ করছি। সূরা বাকারার ১৩ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরামকে সুস্পষ্টভাবে ঈমানের কষ্টিপাথর হিসেবে পেশ করে ইরশাদ করেন—

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آَمِنُوا كَمَا آَمَنَ النَّاسُ


অর্থ: তোমরা ঈমান আনয়ন করো, যেভাবে লোকেরা  ঈমান এনেছে। অন্যত্র বলেন—

   فَإِنْ آَمَنُوا بِمِثْلِ مَا آَمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا


অর্থ: তারা যদি ঈমান আনয়ন করে তোমাদের ঈমানের মত, তাহলে অবশ্যই তারা হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে। (সূরা বাকারা, আয়াত নং-১৩ ও ১৩৭)


মুফাসসিরগণ এ ব্যাপারে একমত যে, প্রথম আয়াতে লোকেরা থেকে এবং দ্বিতীয় আয়াতে তোমাদের থেকে উদ্দেশ্য সাহাবায়ে কেরাম রা.। সুতরাং আয়াতদ্বয় থেকে এটা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়, উম্মতের জন্য সাহাবায়ে কেরামের ঈমান-ই মানদণ্ড ও মাপকাঠি এবং তাদের অনুসরণে-ই হেদায়াতপ্রাপ্তি। 


মানুষের জন্য ঈমান হল সর্বাধিক জরুরী বিষয় এবং তা আমলের ভিত্তি। অধিক জরুরী ও ভিত্তির ক্ষেত্রে যদি সাহাবায়ে কেরামকে মানদণ্ডের স্থান দেওয়া আবশ্যক হয়, তাহলে আমলের ক্ষেত্রে কি অনাবশ্যক? বিচারের ভার পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলাম। 


অনুরূপভাবে মুহাম্মদ আরবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতী আর জাহান্নামী লোকের পরিচয় তুলে ধরে বলেন-  


عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو  قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ  ... وَإِنَّ بَنِى إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلَاثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلَّا مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا: وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي. (أخرجه الترمذي (২৫৬৫) وقَالَ: حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ مُفَسَّرٌ.


সারাংশ: বনী ইসরাঈল বাহাত্তর দলে বিভক্ত  হয়েছিলো। আর আমার উম্মত তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। কিন্তু সব দলই জাহান্নামী। শুধু একদল হবে জান্নাতী। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ঐ জান্নাতী দল কোনটি? মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন- যারা আমার এবং আমার সাহাবাদের পথে সুপ্রতিষ্ঠিত ও অবিচল থাকবে।                                                                                                                                                                               


মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী (রহ.) বলেন, উল্লিখিত হাদীসে আমার পথ বা আদর্শ বলাই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পথাদর্শ বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার সাহাবার সুপ্রতিষ্ঠিত আদর্শের কথা সংশ্লিষ্ট করে দিয়েছেন। যেন ভবিষ্যতে কেউ নবীর সাহাবা থেকে আলাদা হয়ে ইসলামী শরীয়তের রাস্তা নির্ধারণ করতে না পারে। কারণ আল্লাহর দেয়া শরীয়তে তা অগ্রাহ্য। 


এ বক্তব্যের মাধ্যমে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের রাস্তার প্রকৃত ব্যাখ্যা এভাবে প্রদান করলেন যে, নির্দ্বিধায় আমার রাস্তা তা-ই, যা আমার সাহাবাগণ বর্ণনা করবেন বা যার উপর আমল করবেন। (আহসানুল ফাতাওয়া ১/৩০৩, যাকারিয়া বুকডিপো।)


বলাবাহুল্য, এই হাদীস দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আয়াতে কারীমায় মুমিনদের অনুসৃত পথ থেকে সাহাবাদের পথার্দশ তথা বর্ণনা ও আমলকে বুঝানো হয়েছে। কারণ আয়াত ও হাদীসের সারমর্ম এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ রাসূল   ও সাহাবাদের বিরুদ্ধাচরণ করলে জাহান্নামী হওয়া।


আয়াতে কারীমায় “নবীর বিরুদ্ধাচরণ করলে এবং হাদীস শরীফে “আমার পথ বললে” যথেষ্ট হতো। যথেষ্ট হতো অন্যকিছু না বললেও, তাঁর সাথে অন্য কাউকে সংশ্লিষ্ট না করলেও। কারণ- শরীয়ত তো তাঁর উপর-ই নাযিল হয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের উপর তো নয়। এসেছেন জিবরাঈল (আ.) তাঁর কাছে, তাঁদের কাছে তো আসেনি। এতদসত্তেও জান্নাত-জাহান্নামের মাপকাঠির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বর্ণনায় সাহাবায়ে কেরামকে যোগ করতে হলো কেন? 


• প্রকৃতপক্ষে ইনসাফের দৃষ্টিতে যদি চিন্তা করা হয়, তবে এতে কোন সংশয় থাকবে না যে, ইলম ও হিকমত, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, মেধা ও স্মৃতি-শক্তি, ন্যায় ও ধার্মিকতা এবং তাকওয়া ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম অতুলনীয়। কেননা-

 

প্রথমত: তারা হলেন ওহীয়ে এলাহীর সর্বপ্রথম সম্বোধিত ব্যক্তিবর্গ। নবুওয়তী ক্রোড়ে প্রতিপালিত প্রথম কর্মীদল। পয়গামে এলাহীর প্রত্যক্ষদর্শী। প্রেক্ষাপটের সরাসরি অবলোকনকারী। বর্ণনা করেছেন হযরতের অমূল্য বাণী, যা শ্রবণ করেছেন সরাসরি। যার বাস্তবরূপ হিসেবে দেখেছেন নবীর কর্ম-পদ্বতি। তাঁরই নেগরানিতে আমলের অনুশীলনকারী এবং আগন্তুক উম্মতের জন্য উন্নত মুয়ালি­ম ও কামিল মুরশিদ। একারণে কোরআন-সুন্নাহর ইরশাদসমূহের প্রেক্ষাপট ও কার্যকারণ সম্পর্কে পূর্ণরূপ অবগত হওয়া তাদের জন্য কতই না সহজলভ্য।


দ্বিতীয়ত: এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, কোন মানুষের কথার মর্ম সে-ই ভালভাবে বুঝতে পারে, যার সাথে তার গভীর সর্ম্পক ও অন্তরঙ্গতা থাকে। মহানবীর সাথে সাহাবায়ে কেরামের কেমন সম্পর্ক ও ভালবাসা ছিল, তার জ্বলন্ত প্রমাণ কোরআন-হাদীস ও ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত রয়েছে। এভাবে ফিকির করলে আরো  অনেক কারণ বের হবে।


এখন আলোচনা করা যাক প্রথম ছুরত নিয়ে। অর্থাৎ কারো ব্যাখ্যা গ্রহণ না করে আমরা নিজেদের ব্যাখ্যামতে আমল করবো। তাহলে শুনুন! আমাদের ভেবে দেখা দরকার, যে বিষয়ে সাহাবার পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে, সেখানে নিজেদের মত ব্যাখ্যা করে আমল করাটা আল্লাহর কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে? বরং আশঙ্কা হয়, আমার-আপনার এ সমস্ত ব্যাখ্যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ হাদীসটির মেছদাক (বাস্তবরূপ) হয়ে যায় কি না?


عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ خَطَّ لَنَا رَسُولُ اللَّهِ  خَطًّا ثُمَّ قَالَ هَذَا سَبِيلُ اللَّهِ ثُمَّ خَطَّ خُطُوطًا عَنْ يَمِينِهِ وَعَنْ شِمَالِهِ ثُمَّ قَالَ هَذِهِ سُبُلٌ قَالَ يَزِيدُ مُتَفَرِّقَةٌ عَلَى كُلِّ سَبِيلٍ مِنْهَا شَيْطَانٌ يَدْعُو إِلَيْهِ ثُمَّ قَرَأَ {إِنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ}. (مسند أحمد ৪১৪২، صحيح ابن حبان ৬ ، حديث صحيح)


অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে একটি আঁক বা লাইন টানলেন। অতঃপর বললেন- এটা আল্লাহ তাআলার রাস্তা। এরপর তিনি তার ডানে ও বামে কিছু আঁক টেনে বললেন- এগুলো হলো ঐ সমস্ত রাস্তা, যার মধ্যে থেকে প্রত্যেকটার উপর শয়তান বসে লোকদেরকে আহবান করছে যে, এদিকে আস! পরে  রাসূল   কোরআনে মাজীদের এ আয়াত পড়লেন- এটাই আমার সহজ- সরল পথ। সুতরাং তোমরা এ পথের অনুসরণ করো। 


আরও পড়ুন:


প্রশ্ন : সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি-এর অর্থটা কী? যদি বলা হয়- প্রত্যেক সাহাবীর আমল হক তথা অনুসরণীয়; তার খিলাফ বাতিল, তাহলে অনেক সাহাবীর আমল হক ও বাতিল বলে বিবেচিত হবে। কেননা অনেক মাসায়েলের মধ্যে সাহাবাদের মধ্যে মতবিরোধ ছিলো। যেমন- ইমামের পিছনে কেরাত পড়া এবং রাফয়ে ইয়াদাইন ইত্যাদি প্রসঙ্গে। এভাবে সাহাবাদের মধ্যে কারো কারো থেকে ভুল কাজ ও গুনাহ প্রকাশ পেয়েছে। তাহলে সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি-এর অর্থটা কী?


উত্তর : এ ব্যাপারে সবিস্তারে আলোচনায় না গিয়ে সারমর্ম ও মূল কথাটি তুলে ধরছি, যা বাংলাদেশের সাবেক মুফতীয়ে আজম ফয়জুল্লাহ (রহ.)-এর একটি গবেষণাধর্মী আলোচনা। তিনি বলেন- তার অর্থ হলো তিনটি বিষয় (প্রাপ্ত অনুসন্ধান হিসাবে)


১. আকায়েদ অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের আকীদাসমূহ। সেগুলোই হক। তাদের বিপরীত আকীদা বাতিল। সুতরাং যে আকীদা তাঁদের আকায়েদের বিপরীত হবে, তা বাতিল হিসেবে গণ্য হবে। 


২. মাসায়েলে ইজতিহাদিয়া অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের ঐ সমস্ত ইজতিহাদকৃত বিষয়সমূহ, যার উপর তাঁরা অটল ছিলেন। যা থেকে প্রত্যাবর্তন করেননি, নিঃসন্দেহ তা সত্য ও সঠিক। সুতরাং যেই ইজতিহাদ সমস্ত সাহাবার ইজতিহাদের মুখালিফ হবে, তা বাতিল। যেমন- জানোয়ার জবাই করার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে বিসমিল্লাহ তরক করলে, ঐ পশু সমস্ত সাহাবার নিকট হারাম। সুতরাং কেউ যদি এমন পশু খাওয়া হালাল বলে, নিঃসন্দেহে তা বাতিল। যদি কোন কাজী এমন ফায়সালা করে, তা কার্যকর হবে না। কারণ সমস্ত সাহাবার মত এর বিপরীত। (যেমন- এটি হিদায়া গ্রন্থে রয়েছে।) 


৩. তাআমুলে সাহাবা অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের আমল সঠিক। সে অনুযায়ী আমাদের আমল করতে হবে। এর বিপরীত করা যাবে না। সুতরাং যে আমল তাঁদের সবার তাআমুলের বিপরীত হবে, তা সঠিক নয় এবং তা আমলযোগ্য নয়। (জাওয়াহিরুল হিকাম পৃ. ২৭।)

 

সবিস্তারে জানতে দেখুন, আমার র “দাড়ি ও তার পরিমাণ” পৃ. ১২৬-১৪০।

Learn With Iqbal

I'm Muhammad Iqbal Hossain, a language teacher. Languages ignite my passion – their ability to connect us and unlock new worlds. youtube facebook instagram telegram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন