সাইয়েদ কুতুব ও তার কাব্যচিন্তা
সাইয়েদ কুতুব রোমান্টিক ঘরানার কবি ছিলেন। ঠিক ত্রিশ বা পঞ্চাশ দশকের অর্থে আধুনিক কবি ছিলেন না। তবে সাইয়েদ কুতুব আধুনিক কালপর্ব পেয়েছিলেন, আধুনিক সমালোচনা সাহিত্যে কুতুবের বই পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত, আধুনিকতার টানাপড়েন তার মধ্যেও ছিল, তবুও তিনি রোমান্টিক ঘরানার কবি ; তার কবিতায় আছে স্নিগ্ধতা, শব্দের কারুকার্য, সাবেকি ঢঙ্গে রূপসী অলংকারের ঝলসানি। কুতুবের কবিতা গাওয়া যায়, সঙ্গীতের মতো তেলাওয়াত করা যায়। তার কবিতা শব্দ ও কল্পনা সর্বস্ব না, তাতে আছে সুরের উল্লাস !
তিনি বিশ্বাসী ছিলেন, পাশাপাশি তার মধ্যে ছিল ভালোবাসা ও বিদ্রোহ। আল জাজিরায় কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে দেখলাম, তরুণ বয়সে কুতুব প্রেমে পড়েছিলেন।তখনো কুতুব ইসলামে আসেননি। তবে কিছু সমস্যার কারণে বিয়ে অসম্ভব দেখে আরেক বন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন ; কুতুব ছিলেন শারীরিকভাবে দুর্বল ও পরিবারের 'বড়ছেলে', তিনি বুঝেছিলেন 'তাঁকে' অপেক্ষায় রাখাটা ঠিক হবে না। তাই তার পরিচিত একজনের হাতে 'তাঁকে' তুলে দেন।
তরুণ বয়সেই কুতুবের মধ্যে কবি ও কবিতার গুরুত্ব ও ফজিলত স্পষ্ট ছিল। উনিশ শো সাইত্রিশ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি কবিতা বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা পেশ করেন। জীবন, জগত ও রাজনীতিতে একজন কবির দায়িত্ব কী, সে বিষয়ক আলোচনা। পরবর্তীতে এটি বই হিসেবে বের হয়। কবিতার কাঠামো ও দর্শন বিষয়ে তিনি কতটা সচেতন, তার দলীল হিসেবে এই বইটির কথা আনা যেতে পারে। কুতুব তার চিন্তা বিষয়ে এতটা সচেতন ছিলেন যে, এই বইয়ের ভূমিকায় লেখেন, এটা আমার সাহিত্য আকিদা, মুমিন যেমন যেমন তার আকিদার পক্ষে দাড়ায়, আমিও আমার এই বক্তব্যের পক্ষে দাঁড়াবো।
কোরআনের প্রতি ছিল কুতুবের অন্যরকম ভালোবাসা। প্রথাগত আলংকারতত্ত্বের সাথে তিনি রুপকল্পের ধারণা যোগ করেন। কোরআনের রূপকল্প নামে বইটি প্রকাশিত হয়। কোরআনের অধিকাংশ আয়াত শুধু মাত্র শব্দ নয়, আয়াতগুলো একটা রূপকল্পের প্রতিনিধিত্ব করে ; ঈমান-কুফুরের সংঘর্ষ, কিয়ামতের চিত্র, নবীজির মক্কায় দিনকাল ; কুতুব দেখিয়েছেন, এগুলো চলন্ত ঘটমান ইতিহাস, শব্দ শুধু শব্দে শব্দে কুরআনে তৈরি হয়েছে চিত্রকল্প ।
ধীরেধীরে আসে তার মধ্যে ধর্মীয় পরিবর্তন। কুতুবের সবচেয়ে আলোচিত বই মাআলিম ফিত তারিক, পথের দিশা। এখানে সমাজের জাহেলিয়াত ও হাক্কানিয়াতের ইশতেহারের ঘোষণা দেন। ফিকহি অর্থে এতে নানারকম সীমাবদ্ধতা থাকলেও রাজনৈতিক ও অলংকারিক দিক থেকে বইটি ছিল অসাধারণ। শাসকরা তাঁকে ক্ষমা করেনি। এই বইয়ের কারণে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
কবিতা, বিপ্লব, ধর্ম ও সংবেদনশীলতার মধ্যে কোন বিরোধ নেই। উপমহাদেশের প্রায় প্রত্যেক বড় আলেম কবিতা লেখতেন বা কবিতার পাঠক ছিলেন। নাদাবি, থানবি, মানাজির গিলানি, শিবলি নোমানী বা সুলাইমান নাদাবি, সবাই ছিলেন কবিতার সমঝদার আত্মীয়। কুতুব তার ব্যাখ্যায় দেখিয়েছেন, কবিতাহীন বিপ্লব সম্ভব নয়, ধর্ম ও সংবেদনশীলতার পরিপূর্ণ প্রকাশের জন্যেও কবিতা দরকার। দরকার তাদের যৌথ আত্মপ্রকাশের জন্যেও।