উসূলুত তাকফির বা কাউকে তাকফির করার মূলনীতি কি?

"কুফর" শব্দের শাব্দিক অর্থ অস্বীকার করা। আর "তাকফির" শব্দের অর্থ ঈমানদাবীকারী কোন ব্যাক্তিকে কাফের বলা। আজকে আমরা কাউকে তাকফির করার মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করবো। ইনশাআল্লাহ। 

{getToc} $title={Table of Contents}

কুফর এবং কাফিরের মধ্যে পার্থক্য:

প্রথমত একটি সূক্ষ্ম বিষয় খেয়াল রাখতে হবে-"কোন একটি কাজকে কুফর বলে গণ্য করা এবং সেই কাজের কর্তাকে কাফের বলা" উভয়ের মধ্যে বাহ্যিক ভাবে পার্থক্য বুঝে না-আসলেও ফিকহের দৃষ্টিকোণে আসমান যমিন ফারাক রয়েছে। 

যেমন হাদীস শরীফে এসেছে-

اعْدِلْ، فَقالَ: ويْلَكَ! ومَن يَعْدِلُ إذَا لَمْ أَعْدِلْ؟! قدْ خِبْتَ وخَسِرْتَ إنْ لَمْ أَكُنْ أَعْدِلُ. فَقالَ عُمَرُ: يا رَسولَ اللَّهِ، ائْذَنْ لي فيه فأضْرِبَ عُنُقَهُ؟ فَقالَ: دَعْهُ

হুনাইনের যুদ্ধ পরবর্তী গণিমত বন্টনের সময় যুল-খুওয়াইসিরা নামক জনৈক ব্যাক্তি বলল- "হে মুহাম্মদ! ইনসাফ করুন। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,'তোমার ধ্বংস হোক। আমি যদি ইনসাফ না করি তাহলে কে করবে? আমি ইনসাফ না করলে তুমি তো ক্ষতিগ্রস্ত এবং ধ্বংস হয়ে যাবে'। ওমর রাঃ দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাকে তার মাথা কাটার অনুমতি দিন। রাসুলুল্লাহ ﷺবললেন তাকে ছেড়ে দাও। হতে পারে লোকটি নামাজ পড়ে।’’ খালিদ (রা) বললেন, ‘‘কত মুসল্লী'ই তো আছে যে, মুখে যা বলে তার অন্তরে তা নেই।’’ তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন, ‘‘আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয় নি যে, আমি মানুষের অন্তর খুঁজে দেখবো বা তাদের পেট ফেড়ে দেখবো।’’

 ( বিঃদ্রঃ কোন কোন রেওয়ায়েতে ওমর রাঃ এর স্থলে খালিদ বিন ওয়ালিদ রাঃ এর নাম উল্লেখ রয়েছে)  

- বুখারী শরীফ, কিতাবুল মাগাজি।

এই হাদীসে স্পষ্টভাবে যুল-খুওয়াইসিরা রাসুলুল্লাহ ﷺএর সমালোচনা করেছে৷ এতে আমরা বলতে পারি তার কাজটি কুফরী কিন্তু সে কাফের নয়। কারণ খালিদ রাঃ তার মাথা কাটার অনুমতি চাইলে রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে বারণ করেন। সে যদি কাফের হতো তাহলে রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে হত্যা করতে বারণ করতেন না।

উসূলুত তাকফির বা কাউকে তাকফির করার মূলনীতি কি?


সম্মানিত পাঠক- আশা করি আপনারা বুঝতে পেরেছেন কোন কাজকে  কুফর বলে গণ্য করা এবং সে কাজের কর্তাকে কাফের বলা এক বিষয় নয়। অবস্থাবেধে অনেক কুফর কাজের কর্তা কাফের হবে আবার অবস্থাবেদে অনেক কুফর কাজের কর্তা কাফের হবে না। এটা সূক্ষ্মদর্শী  প্রাজ্ঞ মুফতিদের কাজ।

অজ্ঞরা কিভাবে কুফর এবং কাফেরকে মিলেমিশে একাকার করে ফেলে তার চমৎকার একটি উদাহরণ ইমাম শাতেবী রঃ দিয়েছেন- 

আল্লাহ তায়া’লা বলেন-

-  وَمنۡ لَّمۡ یَحکُمۡ بِمَاۤ اَنزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰئِکَ ہُمُ الۡکفِرُوۡنَ 

যারা আল্লাহ তায়া’লার নাযিলকৃত বিধান অনুযাশী ফায়সালা করে না, তারাই কাফির।

(আল মায়িদাহ-৪৪)

 অন্যত্রে এরশাদ হয়েছে- 

ثُمَّ الَّذیۡنَ کَفرُوۡا بِرَبّہِمۡ یَعۡدلُوۡنَ 

এতদ্সত্ত্বেও কাফিরগণ তাদের প্রতিপালকের সমকক্ষ দাঁড় করায়।

ইমাম শাতেবী রঃ বলেন-

খারেজীরা এসব আয়াত নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে। এবং কোন রাষ্ট্র প্রধানকে অন্যায় বিচার করতে দেখলে বলে: "সে কুফুরী করেছে, আর যে কুফরী করেছে সে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করেছে এবং যে সমকক্ষ সাব্যস্ত করে সে শরীক করেছে। কাজেই এজাতি এই আমিরকে মেনে চলে সবাই কুফুরী করেছে। এদের হত্যা করা বৈধ।" 

আল-ই'তিসাম ২/৬৯২পৃষ্ঠা - দারু ইবনি আফফান প্রকাশনী

পাপের কারণে কোন মুমিনকে কাফির বলা:

কবীরা গুনাহ বা অন্যকোন কারণে কোন মুমিনদাবীকারী ব্যাক্তিকে কাফের বলা যাবে কি-না?  এব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের ঐক্যমতের ফতোয়া হলো- কোন মুমিন কবীরা গুনাহের কারণে কাফের নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত স্পষ্ট হওয়া না-যাবে সে এই কবীর গুনাহ হালাল মনে করে করেছে। 

কোন ব্যক্তি মদ খায়। কিন্তু সে মদকে 'হালাল' বলে বিশ্বাস করেনা। তাহলে শুধু 'মদ্যপান' এর কারণে আমরা সর্বোচ্চ তাকে 'ফাসিক' বলতে পারি।

কোন ব্যক্তি জি'নায় লিপ্ত (নাউজুবিল্লাহ)। তবে সে জি/নাকে  হালাল বিশ্বাস করেনা। বরং সে এটিকে খারাপই বিশ্বাস করে, এরপরও নফস-শয়তানের ধোঁকায় পড়ে সে এই কাজে লিপ্ত হয়ে গেছে। 

অনুরূপ 'স*ম*কা*মি*তা' একটি জ/ঘন্য থেকে জ/ঘন্য নি/কৃ/ষ্ট কাজ। এরপরও কেউ ধোঁকায় পড়ে এই পাপে লিপ্ত হয়ে গেলো, কিন্তু সে এই স*ম*কা*মি*তাকে 'হালাল' বিশ্বাস করেনা। তাহলে তাকে আমরা কাফির বলতে পারিনা।

(কিন্তু কেউ যদি প্রকাশ্যে সমকামিতাকে অধিকার, এবং যেনাকে অধিকার, মদ্যপানকে অধিকার হিসেবে দাবী করে তাহলে এই অধিকার দাবী করার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গেলো সে হারাম কে হালাল মনে করেছে; তাহলে তাকে কাফির বলতে বাঁধা থাকলো না। ) 

এ জন্যই ইয়াজিদকে উম্মাহর সিংহভাগ ইমাম লা'নত দিয়ে ফাসিক বলতে রাজি হলেও কাফির বলতে নারাজ। কারণ সে হুসাইন রাঃ কে শহীদ করে চূড়ান্ত পর্যায়ের কবীরা গুনাহ করেছে । কিন্তু "মুমিন হত্যা বৈধ" মনে করে হত্যা করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় নি। কাজেই হুসাইন রাঃ কে শহীদ করে দেওয়ার মতো ন্যাক্কারজনক কবীরা গুনাহ করলেও সে কাফের নয়। 

খারেজিদের দাবী হলো:

من إرتكب الكبيرة فقد كفر- তথা সে কবীরা গুনাহয় লিপ্ত হলো সে কুফরী করলো। এক্ষেত্রে তারা কিছু হাদীস শরীফের বাহ্যিক আক্ষরিক ভাবের উপর ভিত্তি করে দলীল গ্রহন করে থাকে। 

যেমন হাদীস শরীফে এসেছে - من ترك الصلوة متعمدا فقد كفر তথা যে লোক স্বেচ্ছায় নামাজ ত্যাগ করলো সে কুফরী করলো। 

আমাদের একথা স্বরণে রাখতে হবে যে,কুরআন হাদীসে ব্যবহৃত কুফর, নিফাক, ফিসক এবং জুলম দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

১। কখনো এ ধরনের শব্দগুলো অবিশ্বাস, ঈমানের অনুপস্থিতি ও চূড়ান্ত অন্যায় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। 

২। কখনো আবার আল্লাহ তায়া’লার নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতার পাপ, মুনাফিকের গুণ ও সাধারণ পাপ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। 

কাজেই কোন পাপকে কুরআন এবং হাদীসে কুফর,ফিসক,নিফাক বললেই সে কাজের কর্তাকে আম ভাবে কাফির,ফাসিক,জালিম বলা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবে কারো ক্ষেত্রে যদি স্পষ্ট প্রমানাদি পাওয়া যায় তার কথা ভিন্ন।  ব্যাক্তি হিসেবে সে কাফির কিন্তু কোন ভাবেই সম্মিলিত ভাবে এসব কাজের কর্তা আমভাবে কাফির,জালিম মুনাফিক বলার সুযোগ নেই।  

অনুরুপ ভাবে গাইরুল্লাহ কে তা'জিমী সিজদা, গণক, জাদুকর, শাতিমে রাসূলের তাওবা,মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের সাহায্য প্রদানকারী, অঙ্গপ্রতঙ্গ বিকৃতিকারী-এর সমর্থক-প্রচারক ইত্যাদি প্রকাশ্যে কাবীরা গুনাহে লিপ্তদের আমভাবে কাফির ফতোয়া দেওয়ার সুযোগ নেই।  তবে হ্যাঁ! অবস্থা বেধে এদের কেউ কেউ কাফির হতে পারে কিন্তু তার ঘোষণা প্রাজ্ঞ মুফতিরা দিবেন। আবেগকে দমিয়ে রাখতে কষ্ট হলেও এটাই ফিকহের কথা। যাকে তাকে ইচ্ছে মতো কাফির ফতোয়া দেওয়া সাধারণ ত্বলবে ইলম বা ফিকহ- ফতোয়ায় একদম নগণ্য মানুষের ধারণ ক্ষমতার বাহিরের বিষয়। এই বিষয়টি ভালো ভাবে মগজে বসিয়ে নিতে হবে। আল-ওয়ালা ওয়াল-বারায়া মানে এই নয় যে, নিজের অজ্ঞাতার দরুন কাউকে কাফির বানিয়ে নিজেকে কোন হনু মনে করে বসে থাকা।

কোন মুমিনকে কাফির বলার ভয়াবহতা:

কাউকে কাফির সাব্যস্ত করা ইসলামি ফিকহের একটি সেন্সসেটিভ বিষয়। যোগ্যরা এব্যাপারে কথা বলতে হাজারো চিন্তা করেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় সদ্য দ্বীনে ফেরা ভাইটি এর ভয়াবহতা না-বুঝে অজান্তেই অপরকে কাফির বলতে ন্যুনতম চিন্তা করে না। 

আপনি একবার চিন্তা করুন, যাকে আপনি অজ্ঞতা বশত: কাফির বলতেছেন এবং আপনি বুঝেনও তাকে কাফির বলা আপনার কাজ না। কেননা আপনি ইসলামি ফিকহের কিছুই বুঝেন না। দু চারটা লেকচার বা দু চার পৃষ্ঠা পড়ে অপর মুমিন কে কাফির বলতে উঠে পড়ে লেগেছেন। বাস্তবে যদি সে কাফির না-হয় তাহলে নিম্নোক্ত হাদীস গুলোতে আপনাকে নিয়ে কি বলা হয়েছে লক্ষ্য করুন-

১। রাসুল ﷺ বলেছেন, ‘একজন যেন অপরজনকে ফাসিক বলে গালি না দেয় এবং একজন যেন অপরজনকে কাফির বলে অপবাদ না দেয়। কেননা, অন্যজন যদি তা না হয়, তাহলে সে অপবাদ তার নিজের ওপর আপতিত হবে।’ -(বুখারী : ৬০৪৫)

ইবনু হাজার আসকালানি (রহ.) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘সে অপর ব্যক্তিকে যা বলেছে, যদি সে ব্যক্তি তা না হয় তবে সে নিজেই উল্লিখিত অপবাদের উপযুক্ত হবে।আর যদি অপর ব্যক্তি সত্যিকারার্থে তা হয়ে থাকে তাহলে সত্য বলার কারণে তার ওপর কোনো কিছু আরোপিত হবে না। -(ফাতহুল বারি: ১০/৪৬৬)

২। রাসুল ﷺ অন্যত্রে বলেছেন, ‘কেউ তার কোন মুমিন  ভাইকে ‘কাফের’ বলে সম্বোধন করলে উভয়ের একজনের উপর তা ফিরে আসবে। যাকে ‘কাফের’ বলা হয়েছে সে কাফের হলে তো হলোই, নয়তো কথাটি বক্তার উপর ফিরে আসবে। (বুখারী, হাদিস : ৬৪০৪)

পরবর্তী উলামায়ে কেরামের মতামত হলো, যদি গালি হিসেবে কেউ কাউকে কাফির বলে তাহলে গালিদাতা কাফির হবে না। আর যদি এটাই তার আকিদা হয়, তাহলে কাফির হয়ে যাবে।’ (ফয়জুল বারি, শরহে বুখারি : ৬/১৫২)

৩। অপর হাদিসে আরো এসেছে, ‘কোনো মুমিনকে কুফরের অপবাদ দেওয়া, তাকে হত্যা করার নামান্তর। (সহিহ বুখারী, হাদিস : ৬১০৫)

আরও পড়ুন: ফুটবল খেলা কি জায়েজ?

কাউকে কাফির বলার মূলনীতি:

১। ইমামু আজম আবু হানিফা রঃ বলেন, "কোনো পাপের কারণে আমরা কোনো মুসলিমকে কাফির বলবো না, যদিও সে কবীরা গুনাহ করে, এবং যতক্ষণ না সে কবিরা গুনাহকে হালাল মনে করে। কবীরা গুনাহ করা ব্যক্তির ঈমান নেই, এ কথা-ও আমরা বলবো না। বরং, আমরা তাকে প্রকৃত মুমিন হিসাবেই নাম দিবো। কোনো মুমিন ব্যক্তি (সর্বোচ্চ) ফাসেক হতে পারেন, কিন্তু কাফের হতে পারেন না।" [ফিকহুল আকবর]

২। ইমাম ত্বহাবী রঃ বলেন-

 لا نكفر من أهل القبلة أحداً

আমরা আহলে কিবলার কাউকে কাফির সাব্যস্ত করবো না।

৩। ইবনুু তাইমিয়্যাহ (রহ.) বলেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তির উপর নির্দিষ্টভাবে কুফরির হুকুম আরোপ করা যায় না। বরং বলা হবে, যে ব্যক্তি এ কাজ করেছে সে কাফির। অথবা বলবে, এই কাজটি কুফর।’ (মাজমুয়ুল ফাতাওয়া)

(অর্থ্যাত অমুকে কাফির। নাম ধরে বলা যাবে না। বরং বলা হবে একাজ করনে ওয়ালা কাফির। অথবা বলবে এটি কুফরী কাজ।

উপসংহার:

পরিশেষে আমরা বলতে পারি, কাউকে কাফির বলা সাধারণ কোন বিষয় নয়তো বটে উপরন্তু এটি আম জনতার কাজ না। বরং প্রাজ্ঞ মুফতিরা কাউকে উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে কাফির বলে ফতোয়া দিবেন। আল্লাহ তায়া’লা আমাদেরকে বুঝার তাওফিক দান করুক। আমিন।

Learn With Iqbal

I'm Muhammad Iqbal Hossain, a language teacher. Languages ignite my passion – their ability to connect us and unlock new worlds. youtube facebook instagram telegram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন