বাংলাদেশে আরাফার রোযা: গুরুত্ব,ফযিলত ও ইখতেলাফ'সহ বিস্তারিত বিবরণ।

বাংলাদেশে আরাফার রোযা: গুরুত্ব,ফযিলত ও ইখতেলাফ'সহ বিস্তারিত বিবরণ

বাংলাদেশে আরাফার রোযা: গুরুত্ব,ফযিলত ও ইখতেলাফ'সহ বিস্তারিত বিবরণ।


{getToc} $title={Table of Contents}


ভূমিকা

আরাফার রোজা ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল যা ৯ জিলহজ্জে পালন করা হয়। এই দিনটি হজের অংশ হিসেবে আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিন। হজে অংশগ্রহণকারী এবং বাকি মুসলিমদের জন্য এদিন রোজা রাখা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এই রোজার ফজিলত ও পালন নিয়ে কিছু ইখতেলাফ (মতপার্থক্য) দেখা যায়। এখানে আরাফার রোজার তারিখ, এর গুরুত্ব, এবং বিভিন্ন মতপার্থক্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।



আরাফার রোজার গুরুত্ব ও ফযিলত সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কিছু হাদিস নিম্নরূপ:


হজরত আবু কাতাদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:"আরাফার দিনের রোজা, আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, পূর্ববর্তী এক বছরের এবং পরবর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।"

(সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর: ১১৬২)


 হজরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:"আরাফার দিন শয়তান এতটা অপমানিত এবং ক্ষুব্ধ হয় না যতটা ঐ দিনে হয়। কারণ, সে দেখে যে, আল্লাহর রহমত নেমে এসেছে এবং আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অনেক গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন।" (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস নম্বর: ৭৪৫)


ইখতেলাফ:

বাংলাদেশে আরাফার রোজা পালন নিয়ে কিছু ইখতেলাফ রয়েছে। এটি মূলত সৌদি আরব এবং স্থানীয় চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে।


সৌদি আরব অনুসরণ:

বেশিরভাগ মুসলিম সৌদি আরবের চাঁদ দেখার ভিত্তিতে আরাফার রোজা পালন করেন। কারণ হজ এবং আরাফাতের দিন সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত হয় এবং এটি একটি আন্তর্জাতিক ইভেন্ট।


স্থানীয় চাঁদ দেখা:

কিছু মুসলিম স্থানীয় চাঁদ দেখার ভিত্তিতে রোজা পালন করেন। তাদের মতে, স্থানীয় সময় অনুসারে ইবাদত পালন করা উচিত এবং চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে রোজা রাখা উচিত।


আরাফার রোজা কবে :

হাজীরা যেদিন আরাফার ময়দানে অবস্থান করেন সেদিন, না-কি নিজ অঞ্চল ও ভূখণ্ড অনুযায়ী যিলহজ মাসের ৯ তারিখ?


 এ মাসআলা নিয়ে কয়েক দশক থেকে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়; তার পূর্বে এ নিয়ে কোনো মতানৈক্য ছিলো না। সবাই নিজ নিজ অঞ্চল ও ভূখণ্ডের চাঁদ অনুযায়ী ৯ যিলহজ রোজা রাখতো। 


আমরা রোজার সময় ও দিনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই, কিছু রোজার সম্পর্ক চাঁদের সাথে। চাঁদের উদয়-অস্ত অনুযায়ী রোজা রাখতে হয় ও রোজায় বিরতি দিতে হয়। 


যেমন, রমজানের রোজা, শাওয়ালের রোজা, মুহররমের রোজা ইত্যাদি। আবার কিছু রোজার সম্পর্ক চাঁদের সাথে নয়; বরং নির্দিষ্ট দিনের সাথে। যেমন, সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোজা। 


এখন আমাদের দেখা উচিত, আরাফার রোজা কীসের সাথে সম্পৃক্ত : চাঁদের সাথে না-কি নির্দিষ্ট দিনের সাথে? চাঁদের সাথে সম্পৃক্ত হলে নিজ নিজ অঞ্চল ও ভূখণ্ডের চাঁদ অনুযায়ী রোজা পালন করতে হবে; কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল ও ভূখণ্ডের চাঁদ অনুযায়ী নয়। 


আর যদি নির্দিষ্ট দিনের সাথে সম্পৃক্ত হয়, তবে কিয়ামত পর্যন্ত নির্দিষ্ট একদিন তাবৎ পৃথিবীর মানুষকে রোজা পালন করতে হবে। আমরা কুরআন এবং হাদীসে দেখতে পাই- আরাফার রোজা নামে পরিচিত রোযা আরাফার ময়দানে অবস্থানের দিনের রোযা নয় বরং জিলহজ্জ মাসের ০৯ তারিখের রোযা। তথা আমাদের কাছে আরাফার রোজা নামে অভিহিত রোযা চাঁদের সাথে নিজ নিজ অঞ্চল ও ভূখন্ডের জিলহজ্জ মাসের ০৯ তারিখের সাথে পালন করা হবে। মক্কায় আরাফাতের ময়দানে হাজীদের অবস্থানের দিনে নয়।


কেউ হয়তো বলতে পারেন, উপর্যুক্ত আলোচনা যুক্তি নির্ভর। আরাফার রোজা চাঁদের সাথে সম্পৃক্ত, হাদীস থেকে এর কি কোনো প্রমাণ আছে? হ্যাঁ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, তিনি আরাফার রোজাকে যিলহজের চাঁদের সাথে সম্পৃক্ত মনে করতেন; নির্দিষ্ট দিন বা নির্দিষ্ট স্থানের সাথে নয়। 

কোনো এক উম্মুল মুমিনীন বলেন, 

كَانَ رَسولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَصومُ تِسعَ ذِى الْحجَّةِ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যিলহজের নয়দিন রোজা পালন করতেন। (সুনানু আবী দাউদ, ২৪৩৯; )

এ হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়, আরাফার রোজা চাঁদের সাথে সম্পৃক্ত; নির্দিষ্ট দিন বা স্থানের সাথে সম্পৃক্ত নয়। কারণ, এ হাদীসে রোজাকে মাসের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে; নির্দিষ্ট কারণ বা স্থানের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়নি। 


এছাড়া ইসলামে হজের সূচনা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরাফার রোজার রাখার ইতিহাসের দিকে তাকালেও বোঝা যায়, তিনি আরাফার রোজাকে চাঁদের সাথে সম্পৃক্ত মনে করতেন।


গ্রহণযোগ্য ও প্রণিধানযোগ্য মত অনুযায়ী নবম হিজরীতে হজ ফরজ হয়। তার মানে নবম হিজরীর পূর্বে মুসলিমদের আরাফার ময়দানে অবস্থান করার কোনো প্রশ্নই আসে না। 


অথচ আমরা দেখতে পাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবম হিজরীর পূর্ব থেকেই আরাফার রোজা রাখতেন। তিনি জীবনে একবার হজ পালন করেন। সেই হজে আরাফার দিনে তিনি রোজা রেখেছেন কি-না, তা নিয়ে সাহাবীদের মাঝে সন্দেহ হয়।

 উম্মুল ফযল রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,

شكَّ النَّاسُ يَوْمَ عَرَفَةَ فِي صوْمِ النَّبِيِّ فَبَعثْتُ إِلَى النَّبِيِّ بِشَرَابٍ فَشرِبَهُ

আরাফার দিনে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রোজা নিয়ে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পানীয় পাঠালে তিনি তা পান করেন। (বুখারী, ১৬৫৮) 

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইতোপূর্বে সাহাবীগণ আরাফার রোজা রাখতে দেখেছেন বিধায় তাদের মাঝে সন্দেহের উদয় হয় যে, অন্যান্য বছরের মতো আজকে তিনি রোজা রেখেছেন কি-না। ইতোপূর্বে তারা তাঁকে রোজা রাখতে না দেখলে তাদের মনে কোনোপ্রকার সন্দেহ সৃষ্টি হতো না; অন্যান্য সাধারণ দিনের মতোই তারা সেইদিনকেও আমলে নিতেন।


যেহেতু বোঝা যায় তিনি আরাফার দিনে অবস্থান করার পূর্ব থেকেই রোজা রাখতেন, সেহেতু প্রমাণ হয় তিনি চাঁদের হিসেবে রোজা রাখতেন; আরাফায় হাজীদের অবস্থানের হিসেবে নয়। 

 

আর তাছাড়া আরাফার রোজাকে হাজীদের আরাফার ময়দানে অবস্থানের সাথে নির্দিষ্ট করলে বেশকিছু সমস্যা সামনে আসবে। যেমন-


ক. আরাফায় অবস্থানের সাথে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলে সবার জন্য সৌদির চাঁদ অনুযায়ী রোজা পালন করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়বে। আর আমরা দেখতে পাই, কোনো কোনো দেশে সৌদির একদিন আগে চাঁদ উদয় হয়। তার মানে সেসব দেশে যেদিন ঈদ, সেদিন সৌদি আরবের চাঁদ অনুযায়ী আরাফার দিন। আর সর্বসম্মতিক্রমে ঈদের দিন রোজা রাখা হারাম। এভাবে সেসব দেশের অধিবাসীরা আরাফার রোজা পালন থেকে বঞ্চিত হবে। 


খ. পৃথিবী আবার যদি কখনো আধুনিক টেকনোলজি ব্যবস্থা হারিয়ে ফেলে, তখন সৌদিতে কবে আরাফায় হাজীরা অবস্থান করছে, তা অবগত হওয়া সম্ভব হবে না। ফলে আরাফার রোজা রাখাও সম্ভব হবে না।


 এমনকি অধুনাকালেও অনেক দেশ ও অঞ্চল আধুনিক টেকনোলজির বাইরে চলে যায়। নানাবিধ কারণে বিভিন্ন এলাকা ও অঞ্চলের ওপর আধুনিক টেকনোলজি ব্যবস্থা অবরোধ করা হয়। তখন তারা কী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং কীভাবে আরাফার দিন নির্ধারণ করবে? 


গ. যিলহাজ মাসে যে তাকবীর দেওয়া হয় তা দুই প্রকার : মুতলাক তাকবীর ও মুকাইয়াদ তাকবীর। মুকাইয়াদ তাকবীর কখন থেকে শুরু হয় সে ব্যাপারে সাহাবীদের থেকে পাওয়া যায়, তারা আরাফার দিন থেকে আইয়ামুত তাশরীকের শেষদিন পর্যন্ত মোট ৫ দিন তাকবীর দিতেন।


 এখন আমরা যদি আরাফার দিন বলতে আরাফায় অবস্থানের দিন ধরি, তবে যারা সৌদির পর চাঁদ দেখে তাদেরকে ৬ দিন তাকবীর দিতে হবে আর যারা সৌদির আগে চাঁদ দেখে তাদেরকে ৪ দিন তাকবীর দিতে হবে। অথচ এটি হবে সাহাবীদের ইজমা পরিপন্থী।  


ঘ. ইতিহাস বলে, পূর্বে অনেকবার হজ কার্যক্রম বন্ধ ছিলো এবং হাদীস থেকে পাওয়া যায় সামনেও কোন এক সময় হজ কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। 


এখন আরাফার দিন বলতে যদি হাজীদের আরাফার ময়দানে অবস্থান করা বোঝায়, তবে যখন হজ কার্যক্রম বন্ধ ছিলো তখন আরাফার রোজার বিধান থাকার কথা ছিলো না। আবার সামনে যখন বন্ধ থাকবে তখন আরাফার রোজা পালন করার বিধান বাতিল হয়ে যাবে। আর এটি যে একটি বাতিল মত তা বলার অবকাশ রাখে না।  


সংশয় নিরসন : 

যাদের মতে আরাফার রোজা হচ্ছে, হাজীদের আরাফায় অবস্থান করার দিন—তারা তাদের পক্ষে এ হাদীসটিকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেন। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
صِيَامُ عَرفَةَ إِنِّى أَحْتسِبُ عَلى اللَّهِ أَنْ يُكَفّرَ السّنَةَ الَّتِى قَبْلهُ وَالسّنَةَ الَّتِى بَعْدهُ
আরাফার রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহ তায়া’লার কাছে আশাবাদি তিনি এর মাধ্যমে একবছর পূর্বের ও এক বছর পরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।

তারা বলেন, এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফার রোজাকে আরাফার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। অতএব, আরাফার রোজা সেদিন রাখতে হবে, যেদিন হাজীরা আরাফায় অবস্থান করে। 


পর্যালোচনা :

‘ইয়াউমু আরাফা বা আরাফার দিন’ মানে হাজীদের আরাফায় অবস্থান করা অর্থ নয়। বরং ইয়াউমু আরাফা একটি পরিভাষা এবং যিলহজ মাসের ৯ তারিখের একটি নাম। প্রতিটি চন্দ্রমাস ও চন্দ্রদিন-সমূহের নামকরণ করা হয়েছে বিশেষ ঘটনা ও কারণের দিকে লক্ষ্য রেখে। 


কিন্তু পরবর্তীতে সেই ঘটনা ও কারণ বিদ্যমান না থাকলেও সেই নাম পরিবর্তন হবে না; বরং সেই নাম অক্ষত থাকবে। 


যেমন রমজান মাসের নামকরণ করা হয়েছে সেই সময়টা উষ্ণ ও গরম থাকার কারণে। এখন কেউ বলতে পারবে না, ‘উষ্ণ ও গরমকাল ছাড়া রোজা পালন করা যাবে না। কেবল উষ্ণ ও গরমকালেই রোজা রাখতে হবে। কারণ, রমজান মানে গরম ও উষ্ণ সময়।’ 


তো জিলহজ মাসের ৯ তারিখ যেহেতু হাজীরা আরাফায় অবস্থান করে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে ৯ তারিখের নাম রাখা হয়েছে ‘ইয়াউমু আরাফা বা আরাফার দিন’। যদি কখনো হজ বন্ধও থাকে, আরাফার ময়দানে হাজীরা অবস্থান নাও করে, তবুও যিলহজ মাসের ৯ তারিখ ইয়াউমু আরাফা হিসেবে নাম অক্ষত থাকবে।


আরাফায় হাজীরা অবস্থান করবে না বলে তখন আর ৯ তারিখকে ইয়াউমু আরাফা বলা যাবে না, এমনটা হতে পারে না। 


তাই আমরা বলতে পারি ইয়াউমু আরাফা বা আরাফার দিন হচ্ছে জিলহজ মাসের ৯ তারিখের একটি নাম। প্রত্যেক অঞ্চল ও ভূখণ্ডের চাঁদ অনুযায়ী ৯ যিলহজ হচ্ছে তাদের ‘ইয়াউমু আরাফা বা আরাফার দিন’।


 এটাই ছিলো সাহাবী, তাবিয়ী, তাবে-তাবিয়ী-সহ পরবর্তী আলিম ও ইমামগণের মত। যেমন, উমর রা., আলী রা., ইবন আব্বাস রা., ইবন মাসউদ রা. প্রমুখ সাহাবীদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, 

أَنَّهُ كَانَ يُكبِّرُ مِنْ صَلاَةِ الْغَداةِ يَوْمَ عَرفَة إِلَى صلاَةِ الظهْرِ مِنْ آخِرِ أَيّام التّشرِيقِ.

 

আরাফার দিন ফজরের পর থেকে আইয়ামুত তাশরীকের শেষ দিন পর্যন্ত তাকবীর দিতেন। (মুসান্নাফ ইবন আবী শায়বাহ, ৫৬৭৭-৫৬৮১) 

এ হাদীস থেকে প্রমাণ হয় সাহাবীগণ ৫ দিন তাকবীর দিতেন। এটা ছিলো সমস্ত সাহাবীর আমল এবং তাদের ইজমা।


এখানে ইয়াউমু আরাফা বা আরাফার দিন দ্বারা উদ্দেশ্য স্ব-স্ব অঞ্চল ও ভূখণ্ডের যিলহজ মাসের ৯ তারিখ; আরাফায় হাজীদের অবস্থানের নির্দিষ্ট দিন নয়। 


 এ দাবীর প্রমাণ হচ্ছে, সবার মতে এ তাকবীর হবে মোট ৫ দিন। অথচ আমরা যদি আরাফার দিন বলতে আরাফায় অবস্থানের দিন ধরি, তবে যারা সৌদির পর চাঁদ দেখে তাদেরকে ৬ দিন তাকবীর দিতে হবে, আর যারা সৌদির আগে চাঁদ দেখে তাদেরকে ৪ দিন তাকবীর দিতে হবে।


অসংখ্য ইমাম বলেছেন যিলহজ মাসের ৯ তারিখের অপর নাম ইয়াউমুল আরাফা বা আরাফা দিন। অনেক ইমামই বলেছেন, ‘আরাফা’ কোনো স্থানের নাম নয়; বরং সময়ের নাম। অতএব, উল্লিখিত হাদীসে আরাফার দিন দ্বারা আরাফায় হাজীদের অবস্থানের দিন উদ্দেশ্য নয়; বরং যিলহজ মাসের স্ব-স্ব অঞ্চলের ৯ তারিখ উদ্দেশ্য। 


এছাড়া ইয়াউমু আরাফার মতো আরও তিনটি পরিভাষা হলো, ইয়াউমুত তারবিয়্যাহ, ইয়াউমুল ঈদ ও আইয়ামুত তাশরীক। 


ইয়াউমুত তারবিয়্যাহ হচ্ছে, ইয়াউমুল আরাফার আগের দিন তথা ৮ তারিখ। ইয়াউমুল ঈদ হচ্ছে ইয়াউমুল আরাফার পরের দিন তথা ১০ তারিখ আর আইয়ামুত তাশরীক হচ্ছে ১১, ১২, ১৩ তারিখ। 


যারা বলেন, ইয়াউমুল আরাফাহ মানে হাজীরা যেদিন আরাফার মাঠে অবস্থান করে তারা এ চারটি পরিভাষায় গোলোযোগের শিকার হন। তারা ইয়াউমু আরাফা গণ্য করেন সৌদির চাঁদ অনুযায়ী আর বাকী তিনটি পরিভাষা গণ্য করেন স্ব-স্ব অঞ্চলের চাঁদ অনুযায়ী। 


ফলে আমাদের অঞ্চলের চাঁদ অনুযায়ী তারা ইয়াউমুত তারবিয়্যাহ এবং ইয়াউমু আরাফাহ ৮ তারিখে একদিনে গণনা করেন। তারপর ইয়াউমু আরাফার পরের দিনের ইয়াউমুল ঈদকে ইয়াউমুল আরাফার দুদিন পর গণনা করেন। তারপর ইয়াউমু আরাফার দুদিন পরের আইয়ামুত তাশরীককে ইয়াউমুল আরাফার তিনদিন পর গণনা করেন। এমন গণনা চরম হাস্যকর। 


তাছাড়া আমরা যদি ধরেও নিই আরাফার দিন দ্বারা আরাফার ময়দানে হাজীদের অবস্থানের দিন, তারপরও সকল অঞ্চল ও ভূখণ্ডের লোকদের ওপর আরাফার ময়দানে হাজীদের অবস্থানের দিন রোজার আবশ্যকতা প্রমাণ হয় না। 


কারণ, শরীআতের কোনো বিধান কোনো ঘটনা বা স্থান বা কাল থেকে উৎসারিত হলেও সেই ঘটনা বা স্থান বা কালের সাথে উক্ত বিধান খাস হয়ে যায় না। সেই সময়টা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের চাঁদের সাথে নির্দিষ্ট হয়ে যায় না। বরং নিজ নিজ অঞ্চল বা ভূখণ্ডের সাথে উক্ত বিধান পালন করতে হয়। 


যেমন, আশুরার রোজার কারণ হচ্ছে, মুহাররমের ১০ তারিখ মূসা আলাইহিস ওয়া সালাম ফেরাউনের হাত থেকে নাজাত পান। তার কৃতজ্ঞতা স্বরুপ আমাদেরকে মুহাররামের ১০ তারিখ রোজার বিধান দেওয়া হয়েছে।


এটা বলার দরকার নেই যে, যে এলাকার মুহাররমের ১০ তারিখ তিনি নাজাত পান, পৃথিবীর সকল ভূখণ্ডে সেইদিন ১০ তারিখ নয়। যেসব ভূখণ্ড সেই ভূখণ্ডের আগে চাঁদ দেখে তাদের সেদিন মুহাররামের ১১ তারিখ আর যারা পরে দেখে তাদের সেদিন মুহাররমের ৯ তারিখ। 


তাহলে যারা আরাফার রোজাকে সৌদি আরবের  চাঁদের সাথে নির্দিষ্ট করে দিচ্ছেন তাদের উচিত মুহাররামের রোজাকে সেই ভূখণ্ডের চাঁদের সাথে নির্দিষ্ট করে নেওয়া, যে ভূখণ্ডে মূসা আলাইহিস সালাম ফেরাউনের কবল থেকে নাজাত পান। বিষয়টি অনেকটা হাস্যকর। 


আরাফার রোজা নিয়ে আরেকদল রয়েছেন, তারা বলেন, অত শত ইখতিলাফ বাদ দিয়ে সব-দলেই থাকি। তারা বলেন, সতর্কতাবশত ৮ ও ৯ তারিখ আরাফার নিয়্যাতে রোজা রাখাই ভালো। এটি একটি ভুল মত।


আরাফার নিয়্যাতে দুদিন রোজা রাখা অবশ্যই ভুল। এটা দ্বীনে নতুন সংযোজন। কারণ, শরীয়ত অনুযায়ী আরাফার রোজা মাত্র একটি, একাধিক নয়। শরীয়ত একদিনের অতিরিক্ত রোজা পালনের অনুমতি প্রদান করেনি। এমন সতর্কতার দোহাই দিয়ে জুমআর দিন জুমআর নামাজ ছাড়াও সতর্কতাবশত যোহরের নামাজ আদায় করার হয়ে যেতে পারে।


উপসংহার

আরাফার রোজা মুসলিমদের জন্য একটি অত্যন্ত মহিমান্বিত ও ফজিলতপূর্ণ আমল। এটি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ করার কারণ হয়ে থাকে। তাই মুসলিমদের উচিত এই বিশেষ দিনটি গুরুত্বের সাথে পালন করা এবং রোজা রেখে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা। আল্লাহ আমাদেরকে বিষয়টি বুঝার তৌফিক দান করুন। আমীন।


কার্টেসি-আবু জ্বর হাফিঃ  (মূল লেখা তাঁর।আমি ঈষৎ পরিবর্তন করে লিখেছি)


Learn With Iqbal

I'm Muhammad Iqbal Hossain, a language teacher. Languages ignite my passion – their ability to connect us and unlock new worlds. youtube facebook instagram telegram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন