বই: আমার ফাঁসি চাই।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ূর রহমান রেন্টু।
প্রকাশক: স্বর্ণ লতা ও বনলতা।
পৃষ্ঠা:১৫৩।
ক্যাটাগরি: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক।
ভাষা: বাংলা।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ূর রহমান রেন্টু।
প্রকাশক: স্বর্ণ লতা ও বনলতা।
পৃষ্ঠা:১৫৩।
ক্যাটাগরি: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক।
ভাষা: বাংলা।
▌ শর্ট রিভিউ:
বইটি পড়া শুরু করার পূর্বে আপনাকে অবাক করে দেওয়ার মতো তথ্যটি হলো- এই বইটির লেখক বীর মুক্তিযুদ্ধা মতিয়ূর রহমান রেন্টু। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে বয়সে জাফ্রিকবাল ষাড়েরা এবং মুরগী কবিরেরা গর্ত লুকাইছে সে বয়সে মাত্র নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। তিনিই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধা যার প্রবাসী স্বাধীন বাংলাদেশী সরকারের দেওয়া মুক্তিযুদ্ধের সনদ এখনো মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। ভারত সরকার থেকে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তার নাম প্রথম ভলিউমের ৪৬২ নং সিরিয়ালে লিপিবদ্ধ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতৃক প্রতি স্বাক্ষরকৃত ০৪২৭৬ নং মুক্তিযুদ্ধের সনদটি এই লেখকের। মতিয়ূর রহমান রেন্টু সাহেব ১৯৮১ সালের ১৭ই মে থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ষোল বছর শেখ হাসিনার অলিখিত কনসালটেন্ট থাকেন। এবং তার স্ত্রী নাজমা আক্তার ময়না ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ০৯ নছর শেখ হাসিনার অবৈতনিক হাউজ সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী এই দীর্ঘ সময়ে প্রাইম মিনিস্টারের কাছাকাছি থাকার দরুন বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক নেপথ্যের সাথে লেখক সরাসরি জড়িত। আর এই বিষয়গুলো লেখক তুলে ধরেছেন এই বইতে। একটু সহজে বললে ৮১'থেকে ৯৭ পর্যন্ত অনেক কিছুই ফাঁস করে দিয়েছেন। এই বইটি রাজনৈতিক প্রতারণা বুঝার জন্য তরুণদের প্রতি হাই রিকমন্ডেড।
১। আগরতলার ষড়যন্ত্র মূলক মামলায় অভিযুক্ত কারোরই বাংলাদেশ স্বাধীন করার চিন্তা মাথায় ও আসে নি। পাকিস্তান সরকার এই মামলা করেছিলো অধিকার নিয়ে সচেতনমুখর বাঙালিদের অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে করে দেওয়ার স্বার্থে। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ'সহ অন্যান্য রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের নির্বাচনে অংশ গ্রহনের মাধ্যমে বিষয়টি আরো ফুটে উঠে। তবে মজলুম জননেতা রেড মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী এর নেতৃত্বে তখনই নির্বাচন বর্জন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রকাশ্য ঘোষণা আসতে থাকে। যেমন ৭০-এর নির্বাচনে তার স্লোগান ছিল- 'নির্বাচনে লাথি মার পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর'।
২। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান স্বাধীনতার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র তিনি কামনা করেন নি। কারণ ৭-ই মার্চের ভাষণে রাস্তাঘাট কলকারখানা বন্ধ করার কথা বললেও পাকিস্তান সৈন্য এদেশে আনা যাবে না এমন কোন ঘোষণা তিনি দেন নি। শেখ মুজিবের অনিচ্ছার কারণে সম্পূর্ণ বক্তব্য ৪টি শর্ত আরোপ করেই শেষ হলো। তিনি কেমন জানি স্বাধীনতার ঘোষণা করেও করলেন না। যার ফলে ৭-ই মার্চের পরেই পাকিস্তানিরা তেজগাঁও বিমানবন্দরে সৈন্য সমাবেশ শুরু করে। অথচ ৭-ই মার্চের সময়ে পূর্ব বাংলায় অফিসার পর্যায়ে মুষ্টিমেয় সৈন্য ছিলো। তাদের সাথে বাঙালি পুলিশ এপিআর বাহিনীর যুদ্ধ এক সপ্তাহের বেশি দীর্ঘায়িত হতো না। ইচ্ছে না-থাকায় শেখ মজিবুর রহমান যুদ্ধের স্পষ্ট ঘোষণা দেন নি। ফলশ্রুতিতে বাধ্য হয়েই বাঙালিরা পাকিস্তানের জুলুম এবং হত্যাযজ্ঞের কারণে অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়। সহজে বললে পাকিস্তানিরা আমাদের উপর এ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। এদেশের কেউ এ যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে শুরু করে নি। শেখ মজিবুর রহমানের ৭-ই মার্চের চারটি শর্ত হলো-
★ মর্শাল 'ল' তুলে ফেলতে হবে।
★ সেনাবাহিনী সদস্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।
★ আন্দোলনে নিহত ব্যাক্তিদের হত্যার তদন্ত করতে হবে।
★ জনগনের প্রতিনিধির কাছে (শেখ মজিবুর রহমানের কাছে) প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিতে হবে।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় বলতে হয় ' এ যাত্রায় পাকিস্তানের শাসক শেখ মজিবুর রহমানের চারটি শর্ত মেনে নিলে আর যা হোক, বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না'। শেখ মজিবুর রহমানের মূলমন্ত্র ছিলো পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগন হলো বাঙালি। কাজেই পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী হবে বাঙালি, পাকিস্তানি নয়। জনগণের নির্বাচিত নেতার হাতে শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দিবে এটাই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের মূল ইচ্ছে। ঐতিহাসিক চিত্র বিশ্লেষণ করলে বুঝাযায় তিনিই অখণ্ড পাকিস্তানের সমর্থক সর্বশেষ বাঙালি। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা তিনি কামনা করেন নি। ০৭-ই মার্চের ভাষন ছিলে ট্রিমেনডাস কন্ডিশন্যাল স্পিচ। অর্থাৎ পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধরে রাখার শর্ত হলো এই চারটি শর্ত মেনে নেওয়া। নয়তো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সতর্ক হুশিয়ারি দেওয়া।
৩। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে জাতির সত্যিকারের মুক্তির আশায় সর্বহারা বাহিনীর কমান্ডার সিরাজ শিকদার এর নেতৃত্বে দেশে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে শেখ মজিবুর রহমানের চেয়ে তার জনসমর্থন অনেক বেড়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে শেখ মজিবুর রহমান তাকে বন্দি করে হত্যা করেন। এবং পচাত্তরে প্রধানমন্ত্রী থেকে প্রেসিডেন্ট হয়ে দেশে সকল রাজনৈতিক দল কে নিষিদ্ধ করেন। সাথে চারটি পত্রিকা ছাড়া সকল পত্রিকা নিষিদ্ধ করে দেন। এবং একজাতীয় বাকশালি সরকার গঠন করেন। যার ফলে পঁচাত্তরের আগস্ট মাসে তার নিহত হওয়ার ঘটনায় মুষ্টিমেয় কিছু আওয়ামী লীগ ছাড়া আওমীলীগের অন্যান্য নেতা কর্মী'সহ আপামর জনতার মৌন সমর্থন ছিল। এটা বুঝাযায় শেখ মজিবুর রহমান পরবর্তী প্রেসিডেন্ট খন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী পরিষদের আনুগত্য প্রদশর্নের মাধ্যমে। নেতৃত্বেস্থানীয়দের মধ্যে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং কাদের সিদ্দিকী ছিলেন এর ব্যাতিক্রম।
৪। ৮১-সালের শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আসার তিন-চার দিন পর কর্মীদের সাথে প্রথম মিটিংয়ে নির্দেশ দিলেন- সবাই যেন ঘোষণা করে এই জিয়া সেই জিয়া নয়। এবং জিয়া হত্যার পরিকল্পনা বিষয়ে শেখ হাসিনা অবগত রয়েছেন -৪১,৪২ পৃষ্ঠা।
৫। ৮১'র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শেখ হাসিনা নির্বাচন পিছানোর জন্য যেকোন একজন প্রার্থীকে হত্যার নির্দেশ দেয়। এবং পরবর্তীতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট দখল করার জন্য গোপনে আয়োজনে ঘি ঢালতে থাকেন। প্রশিক্ষণের জন্য ফিলিস্তিনি সংগঠনের সাথে চুক্তি করে লেবাননে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহনের জন্য অসামরিক লোক পাঠানো হলো। ঘটনাক্রমে ইসরাঈল লেবাননে আক্রমণ করে এসব প্রশিক্ষণ প্রার্থীদের আটক করে ফেলে। এহেন বিপদের সময় শেখ হাসিন গা ঢাকা দিয়ে চুপচাপ হয়ে থাকেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান রেডক্রস এর সহায়তায় তাদেরকে ফিরিয়ে আনা হয়। এবং ঢাক - ৪৪পৃষ্ঠা
৬। শেখ হাসিনার গোপন চুক্তিতে এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। পরবর্তীতে এরশাদ চুক্তি বঙ্গ করলে শেখ হাসিনা পরিকল্পনা করে ৮৩ এবং ৮৪ সালে ছাত্রদের মাধ্যমে মিছিল করান। এবং মিছিল চাঙা করা, সাথে এরশাদকে চাপে রাখতে পরিকল্পিত ভাবে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে ছাত্রদের মিছিলে হত্যা করান। এবং গোপন স্বার্থ আদায় করে নেন। পৃষ্ঠা-৪৭
৭। জাহানারা ইমাম কর্তৃক গন আদালতে জামাতে ইসলামির গোলাম আজম সাহেবের ফাঁসির রায় হলে বিএনপির লেজুড় ছেড়ে আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করার শর্তে আওয়ামী লীগ আদালতের রায় বানচাল করার দায়িত্ব নেয়।
৮। ৯২-এর হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শেখ হাসিনা নিজে অর্থ দিয়ে এই বইয়ের লেখক মুতিয়ূর রহমান রেন্টুর মাধ্যমে করিয়েছে।
৯। এই বইতে কমন একটা জিনিস পেলেম৷ হিন্দু হত্যা এবং তাদের উপাসনালয় ধ্বংসে আওয়ামী লীগের হাত সবচেয়ে বেশি। মানে তারা নিজেদের স্বার্থে তাদের সমর্থক হিন্দুদের যেকোন সময় বলি দিতে কার্পণ্য করে না।
১০। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, ভারতকে করিডোর,ট্রানজিট,মঙলা বন্দর দেওয়ার চুক্তি ৯৬তেই হয়েছিল। সময় সাপেক্ষে ২৪সাল পর্যন্ত দেরি হয়েছে মাত্র।
১১। ৯১ থেকে ৯৬ পর্যন্ত আন্দোলনে মিছিলে ১০৩ জন লোক নিহত হয়েছিল। এদের কেউ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়নি। বেগম জিয়াাকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য শেখ হাসিনা নিজে এই হত্যা কান্ড গুলো ঘটান।
১২। মুক্তি যুদ্ধের চেতনা কি? মুক্তি যুদ্ধের চেতনা হলো- নিজের চাইতে অন্যকে বড় করে দেখা। বেশি ভালোবাসা। নিজের ব্যাক্তি স্বার্থের চেয়ে দেশ জাতির স্বার্থ কে বড় করে দেখা।
এক বাক্যে এই বইয়ের রিভিউ জানতে চাইলে বলবো- শেখ হাসিনা ক্ষমতা দখল করার স্বার্থে মতিয়ূর রহমান রেন্টু সাহেবের মাধ্যমে যেসব অপকর্ম করিয়েছিলেন ; অবাঞ্ছিত ঘোষণা হওয়ার পরে তিনি তার সব জবান বন্দি এই বইতে দিন তারিখ'সহ উল্লেখ করেছেন।
একজন ক্ষমতা লোভী নারী কতটা হীন হতে পারেন এই বইটা পড়ে তা জেনে আপনি আঁতকে উঠবেন। কোন কোন অংশে মনে হবে ট্রয় নগরীর হেলেনের চেয়ে ভয়ংকর তার প্রতারণা। নিজের স্বার্থে মানুষ মারা তার কাছে পান্তাভাত মনে হয়।
শেখ হাসিনার এসব অপকর্ম জানতে আপনার বইটি পড়া উচিত। ৯-সাল পরবর্তী তার প্রতিটি কর্মকাণ্ড এবং চলমান পরিস্থিতিতে তার সিদ্ধান্ত কি আসতে পারে তার একটা সহজ উপলব্ধি পেতেও পড়তে পারেন। সর্বশেষে জবান বন্দি দেওয়ার পর তিনি তিনজন লোকের ফাঁসি চেয়েছেন-
১। লেখকের নিজের।
২। তাকে ইন্ধনদাতা শেখ হাসিনার।
৩। সঙ্গত কারণে শেখ মুজিবুর রহমানের।
আরো পড়ুন: বই: অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা